
ওকে-খ ঋরহধষ
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও দেশীয় বাজার ব্যবস্থার অস্থিরতার কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এখন সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের সমস্যা। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) স্বল্প মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে জনগণকে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে বাস্তবতা হলো, এই উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত অব্যবস্থাপনা, পণ্য সংকট ও দুর্নীতির কারণে ভোগান্তির মাত্রা আরও বেড়ে গেছে।
টিসিবির পণ্যে চাহিদা ও সরবরাহের অসামঞ্জস্য টিসিবির পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো চাহিদার তুলনায় সরবরাহের অপ্রতুলতা। দেশের দ্রব্যমূল্য যখন অস্বাভাবিকহারে বেড়ে চলেছে, তখন শুধু দরিদ্র মানুষ নয়, নিম্নমধ্যবিত্ত ও এমনকি মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকেই টিসিবির ট্রাকের লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে চাহিদার পরিমাণ বহুগুণ বেড়ে গেছে, কিন্তু সরবরাহ সেই তুলনায় বাড়ানো হয়নি। ফলে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েও বহু মানুষ খালি হাতে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এ ছাড়া কিছু এলাকায় এক ট্রাকে মাত্র ৩০০-৪০০ জনের জন্য পণ্য বরাদ্দ থাকে, যেখানে লাইনে দাঁড়ায় ১,০০০-এর বেশি মানুষ। আবার কিছু স্থানে ট্রাক পৌঁছানোর সময়সূচি অনিয়মিত ও অগ্রিম তথ্য প্রদান করা হয় না। ফলে সাধারণ জনগণকে অনিশ্চয়তার মধ্যে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়।
বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি ও অনিয়ম
টিসিবির পণ্য বিতরণের ক্ষেত্রে নিয়মিতভাবে বিশৃঙ্খলা ও অনিয়ম দেখা যায়Ñ
১. হুড়োহুড়ি ও বিশৃঙ্খলা : পণ্য নিতে আসা মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়ায় ট্রাক আসার সঙ্গে সঙ্গেই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। শারীরিকভাবে দুর্বল, নারী ও বৃদ্ধরা পণ্য না পেয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হন।
২. দুর্নীতি ও প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ: কিছু স্থানে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাদের পরিচিতদের জন্য আগেভাগে পণ্য নিয়ে রাখেন বা নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে বেশি পণ্য সংগ্রহ করেন। অনেকে আবার লাইনে না দাঁড়িয়ে সরাসরি পণ্য কিনে নিয়ে যান।
৩. কালোবাজারি ও পুনঃবিক্রয়: অনেক সময় দেখা যায়, টিসিবির পণ্য সংগ্রহ করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বেশি দামে তা পুনঃবিক্রয় করছেন। এতে প্রকৃত সুবিধাভোগীরা বঞ্চিত হচ্ছেন।
ভোগান্তির কারণ ও সরকারের দায়
সরকারের উচিত টিসিবির পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর আরও কঠোর নজরদারি বাড়ানো। যদিও টিসিবির সক্ষমতা রাতারাতি বাড়ানো সম্ভব নয়, তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, এডিপির অব্যবহৃত অর্থ ব্যবহার করে টিসিবির কার্যক্রম স¤প্রসারণ করা যেতে পারে। একই সঙ্গে বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর কঠোর নজরদারি প্রয়োজন, যাতে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে জনগণকে সংকটে ফেলতে না পারে।
সম্ভাব্য সমাধান ও সুপারিশ
টিসিবির পণ্য বিতরণ কার্যক্রমকে আরও সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও জনবান্ধব করতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
সরবরাহ বাড়ানো : চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকলে জনগণের ভোগান্তি বাড়বে। তাই সরকারের উচিত টিসিবির জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ করা এবং অতিরিক্ত পণ্য আমদানি বা উৎপাদনের ব্যবস্থা করা।
টোকেন বা ডিজিটাল ব্যবস্থা : মানুষের লাইনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার ভোগান্তি কমাতে টোকেন পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মোবাইল অ্যাপে বা এসএমএসের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়সূচি জানিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
প্রশাসনিক মনিটরিং : স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোরভাবে টিসিবির ট্রাক বিতরণ কার্যক্রম তদারকি করতে হবে, যাতে দুর্নীতি ও প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করা যায়।
বাজার সিন্ডিকেট ভাঙা : শুধু টিসিবির ওপর নির্ভরশীল না থেকে বাজার ব্যবস্থাপনার দিকে কঠোর নজর দিতে হবে, যাতে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে না পারে।
স্থান ও ট্রাক সংখ্যা বৃদ্ধি : নগর ও মফস্বল এলাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে টিসিবির ট্রাক সংখ্যা বাড়িয়ে বিতরণের পরিধি বাড়ানো জরুরি।
টিসিবির বিকল্প ব্যবস্থা : টিসিবির পাশাপাশি সরকারি ন্যায্যমূল্যের দোকানের সংখ্যা বাড়িয়ে প্রতিটি ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ে খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে।
টিসিবির পণ্য বিতরণ ব্যবস্থা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তা যদি কার্যকরভাবে পরিচালিত না হয়, তবে সেটি উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারবে না। অনিয়ম, দুর্নীতি ও সরবরাহ ঘাটতির কারণে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। সরকার ও প্রশাসনের উচিত এই সংকট মোকাবিলায় দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ, টিসিবির কার্যক্রমের উন্নয়ন ও দুর্নীতি দমন করা গেলে সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘব হবে এবং প্রকৃতপক্ষে তারা এই সহায়তার সুফল ভোগ করতে পারবে।
লেখক : শিক্ষক