ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৬ মার্চ ২০২৫, ২২ ফাল্গুন ১৪৩১

ক্ষমতা শক্তি ও ছায়া শক্তি

ফনিন্দ্র সরকার

প্রকাশিত: ২০:১৫, ৬ মার্চ ২০২৫

ক্ষমতা শক্তি ও ছায়া শক্তি

ক্ষমতা ও শক্তি নিয়ে মনুষ্য সমাজে বিস্তর আলোচনা রয়েছে। রাজনীতি ও সমাজ-নীতির মধ্যে শব্দ দুটো ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে চলছে। ক্ষমতা ও শক্তি একটি অপরটির পরিপূরক। শক্তি না থাকলে ক্ষমতা অর্জন সম্ভব নয়। আবার ক্ষমতা শক্তিকে ত্বরান্বিত করে। শক্তির পেছনে আরও একটি রয়েছে, যা দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, অতীব স্পর্শকাতরÑ যেটিকে বলা যেতে পারে ছায়াশক্তি। অবশ্য ছায়াশক্তির আলোচনা তেমন নেই। রাজনীতিতে একটি কথা বা প্রচলিত বাক্য আছেÑ সেটি হচ্ছে জনগণই ক্ষমতার উৎস। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জনগণকেই ক্ষমতার নিয়ামক হিসেবে গণ্য করা হয়। ক্ষমতা, শক্তি ও ছায়াশক্তি বিষয়ে আমাদের অবশ্যই আরও বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে চিন্তা ও অনুভব করতে হবে। বিষয় ও ব্যক্তির ক্ষেত্রেও এর গুরুত্ব বিবেচনা করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। বাহ্যিকভাবে এই শব্দগুলোর যাচ্ছেতাই ব্যবহার দেখতে পাই। মানুষের মধ্যেই এ সম্ভাবনা চাপা রয়েছে। আমরা এ জগতের বহু ব্যষ্টির মধ্যে এক একটি ব্যষ্টি নয়। একটি টেবিল বা চেয়ার কিংবা অন্য একটি আসবাব, এটা, ওটা আমাদের প্রকৃত স্বরূপের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে না। এ সত্যের সামান্য যখন আমাদের বোধগম্য হয়, তখনো আমাদের ধন-সম্পত্তি থাকে। কিন্তু আমরা এগুলোর দাস হয়ে থাকব না। ধন-সম্পত্তির দাস হয়ে যারা থাকতে চায়, তাদের মধ্যে ক্ষমতা ও শক্তির অহংকার বিদ্যমান। কোনো রাষ্ট্রনায়ক অথবা কোনো ব্যক্তি রাজনৈতিক বড় নেতা বুক টান করে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে রাজপথ কাঁপানো বক্তব্যে নিজেকে ক্ষমতার প্রাবল্যে উপস্থাপন করেন। তিনি কার্যত কোনো ক্ষমতার অধিকারী নন।
সহজভাবে আমরা রাজনীতিতে ক্ষমতার চর্চা দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। তাই এ নিয়ে কিছু কথা না বললে প্রিয় পাঠকের প্রকৃত খোরাক তৈরি হবে না। রাষ্ট্র ক্ষমতার একটা ভিন্ন আঙ্গিক রয়েছে। কোনো শক্তি বা অপশক্তির ওপর ভর করে যখন কেউ সর্বোচ্চ ক্ষমতার চেয়ারে বসেন, তখন তিনি প্রায় অন্ধ হয়ে যান। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক হচ্ছে সেই রাষ্ট্রের সকল মানুষ। মানুষের রায়ে কিংবা ভোটে ক্ষমতা প্রাপ্ত ব্যক্তি শাসক হিসেবে পরিগণিত। এর অর্থ হচ্ছে ক্ষমতার পেছনের শক্তি জনগণ। জনগণের সম্মিলিত শক্তিই কাউকে না কাউকে ক্ষমতাবান করে। তাই এই ক্ষমতার সদ্ব্যবহার অপরিহার্য। জনগণের শক্তির দ্বারা গঠিত ক্ষমতা যদি জনগণের ওপর অপব্যবহার হয়, তবে সেই ক্ষমতার তখ্ত তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। পৃথিবীতে রাজনৈতিক ইতিহাস এ রকম অসংখ্য নজির স্থাপিত হয়েছে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি রাজনৈতিক সংগঠন থাকে। সেই রাজনৈতিক সংগঠনের নীতি ও আদর্শ কী তা জনগণের কাছে পরিষ্কার করতে হয়। দলের দর্শন কীÑ তারও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকতে হবে। জনগণ যদি কোনো দলের নীতি, আদর্শ ও দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হয় তখন সেই দলকেই জনগণ সমর্থন দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন করে। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার অত্যন্ত শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ধরনের সরকার জনগণের কাছে দায়বদ্ধ অনেক বেশি থাকে বিধায় ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে না। রাষ্ট্র ক্ষমতা যারা অনুশীলন করেন, তাদের ক্ষমতা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে। এ বিষয়ে জ্ঞান না থাকলে ক্ষমতার ভারে নুয়ে পড়তে পারে। ক্ষমতার জ্ঞানে যারা সমৃদ্ধ তারা ছায়াশক্তির অধিকারী হয়। ছায়াশক্তি অদৃশ্য শক্তি যা নিজের অন্তর জগৎ থেকে সৃষ্টি করতে হয়। যারা শক্তি সৃষ্টি করতে পারে, তাদের পতন হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। আমরা সাধারণত ছায়াশক্তিকে নেতিবাচক অর্থে বোঝার চেষ্টা করি। তৃতীয় কোনো পক্ষ কিংবা কোনো বহিঃশক্তির ইশারাই ছায়া শক্তি। কার্যত এ ধরনের শক্তি ছায়া শক্তি নামের অপশক্তি। অপশক্তি বেষ্টিত ক্ষমতার কোনো মূল্য ও মর্যাদা থাকে না। ছায়াশক্তির মূল উৎস হচ্ছে আধ্যাত্মিকতা। মানব মন সামান্য একটু আধ্যাত্মিকতার, সামান্য স্থিতপ্রজ্ঞ দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা প্রভাবিত হয়। সুতরাং স্থিতপ্রজ্ঞ পর্যায়ে মানুষের মধ্যে ত্যাগ ও সেবার ভাব জেগে ওঠে। এই ভাবটার পূর্ণাঙ্গরূপ ছায়াশক্তি। অন্তরে অধিষ্ঠিত শ্রেয়স্কর বস্তুটিকে উপলব্ধি করতে হবে। যিনি উপলব্ধি করতে পারেন, তিনি তার শ্রেষ্ঠত্বকে আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। অন্তরস্থ অসীম সত্তা কর্তৃক ন্যস্ত জীবনই অতীব ক্ষমতার অধিকারী। জনতার শক্তি প্রাপ্ত হয়ে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যদি অহংকারী না হয়ে অন্তর সত্তা দ্বারা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, তাকে কখনো পরাজয় বরণ করতে হয় না। এই ছায়াশক্তি হচ্ছে জ্ঞানের দ্বারা আবৃত। এতে মনুষ্যত্ব বিকশিত হয়ে ওঠে। মনুষ্যত্বহীন সমাজ কখনো আলোকিত হতে পারে না। জীবনের প্রত্যেকটি স্তরে জ্ঞানের প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। কারণ, এই অনন্ত শাশ^ত আত্মার ওপর রয়েছে আমাদের জন্মগত অধিকার। এ বিষয়ে চর্চার অপরিহার্যতা জীবনকে সমৃদ্ধ করবেই। জীবনে সাফল্য অর্জন করতে হলে একটু মানসিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। বহুবিধ আন্তর্জাতিক পুরস্কার এবং আন্তর্জাতিক ডিগ্রি ও সম্মানই সাফল্যের মাপকাঠি নয়। চঞ্চল মন কোনো মহৎ কাজ করতে পারে না। আজকাল বিশে^র অধিকাংশ রাষ্ট্রশাসকের চঞ্চলতা ও অস্থিরতায় মনুষ্য সমাজ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। যার মন দুঃখে উদ্বিগ্ন হয় না, যিনি সুখের জন্য লালায়িত নন, যিনি বিবেচনাহীন আসক্তি, ভীতি, ক্রোধ থেকে মুক্ত, বাস্তবিক তিনিই হলেন স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি। শাসক হিসেবে স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠ। তিনি জাতিকে দিশা দিতে পারেন। গঠন করতে পারেন চরিত্রবান নাগরিক।
অধিকাংশ রাষ্ট্র যখন গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার দ্বারা পরিচালিত, তখন গণতন্ত্রের সাফল্য কিভাবে ধরা দেবে সে বিষয়ে চিন্তা করতে হবে। গণতন্ত্রের সাফল্য নির্ভর করে সংখ্যাধিক্য লোকের চিন্তাশক্তির জাগরণ এবং লোকপ্রীতি ও জনসেবামূলক কার্যক্রমে শামিল হওয়ার সামর্থ্যরে ওপর। যাদের জীবন অসংযত, আবেগে ও কাজের নামে অকাজে মাতামাতিতে ভরা, তাদের দ্বারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নস্যাৎ হয়ে যায়। গণতন্ত্রকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন বেশি সংখ্যক গুণসম্পন্ন মানুষের। রাষ্ট্রনায়ক যদি স্থিতপ্রজ্ঞ হন, তবে সে রাষ্ট্রের নাগরিকও গুণ অর্জন করতে বাধ্য হয়। মানুষ তার অন্তর থেকে যখন ছায়াশক্তি অর্জন করতে পারে তখনই সমস্ত ভয়, দ্বিধা, দ্বন্দ্ব ও সংঘাতময় পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারে। ঐ শক্তি তাকে সব সহ্য করার ক্ষমতা প্রদান করে। ক্রোধ দমন করা খুব কষ্টসাধ্য। তার জন্য চাই মনের প্রশিক্ষণ। প্রথমে আমরা ক্রুদ্ধ হই, কিছু পরেই আবার ঠান্ডা হয়ে যাই। তারপর আমাদের অবশ্যই চিন্তা করতে হবে। কেন আমি ক্রুদ্ধ হয়েছিলাম? সংযম হারিয়েছিলাম! আবার চেষ্টা করব। এভাবে ছায়াশক্তিকে কাজে লাগিয়ে উচ্চতর উদ্দেশ্যের প্রতি আত্মোৎসর্গের মনোভাব নিয়ে ভয় বিদ্বেষ মন্দ আবেগগুলো বশীভূত করতে পারি। হার্ভার্ড বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক উইলিয়াম ম্যাক্ ডুগ্যালের লেখা Character and the Conduct of Life গ্রন্থে ক্রোধ সমস্যার সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন, একে নিয়ন্ত্রণে আনার এবং কাজে লাগানোর উপায়ের কথাও বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘জীবনে ক্রোধেরও প্রয়োজন আছে’। মনস্তত্ত্বের দিক থেকে কোনো আবেগই এমনকি ক্রোধও স্বরূপে মন্দ নয়। কিন্তু জানতে হবে কিভাবে এদের কাজে লাগানো যায়। মানব জীবনে ক্রোধেরও একটা স্থান আছে। তোমার আশপাশে কিছু অন্যায় হচ্ছে দেখলে; তোমাকে অবশ্যই সংযত ক্রোধের উদ্রেক ঘটাতে হবে। তোমার মনে ক্রোধ না থাকলে সঠিক প্রতিকার করতে পারবে না। মন্দ কাজ বেড়েই চলবে। অতএব, ক্রোধকে সামাজিক কল্যাণের উদ্দেশ্যে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। ন্যায়বিচারের স্বার্থে ক্রোধকে কাজে লাগাতে হবে। এটি হচ্ছে চরিত্র গঠন প্রশিক্ষণের অন্যতম অংশ। ন্যায়সংগত ক্রোধ শক্তির উৎস ধারায় প্রবাহিত। বিজ্ঞানের ভাষায় ক্ষমতা ও শক্তির সংজ্ঞা আলাদা হলেও অন্তর্নিহিত ভাব এক ও অভিন্ন। বিজ্ঞানে যেমন একক সময়ের কাজ দ্বারা ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়, ক্ষমতা নির্ণয়ে সময়ের প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে শক্তি হচ্ছে মোটকৃত কাজ দ্বারা শক্তি পরিমাপ করা। তাই শক্তি নির্ণয়ে প্রয়োজন হয় না সময়ের। তবে অন্তর থেকে ছায়াশক্তি তৈরিতেও সময়ের প্রয়োজন পড়ে। দৃষ্টিভঙ্গিতে আমাদের ক্ষমতা ও শক্তিকে যথাযথ জায়গায় স্থান দিতে হবে। এর প্রায়োগিক দিকটা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বিচার করতে হবে। গণতন্ত্রের আগে মানবতন্ত্রের গভীরে প্রবেশ করে খুঁজে বের করতে হবে শক্তিকে। সেখানে কোন শক্তি কাজ করেছে, সেটা যদি বুঝতে পারি, তবে নিজের ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে পারব।   


লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]

×