ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৬ মার্চ ২০২৫, ২২ ফাল্গুন ১৪৩১

স্বাধীনতার সূচনাপর্ব

ড. মো. আবু তাহের

প্রকাশিত: ২০:০৬, ৬ মার্চ ২০২৫

স্বাধীনতার সূচনাপর্ব

বিশ্ব নেতারা যুগ যুগ ধরে অনেক ভাষণ দিয়েছেন এবং আগামীতেও দেবেন। এর মধ্যে কতগুলো ভাষণ জনমনে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। ৭ মার্চের ভাষণ তেমনিই একটি। এ ভাষণ সম্পর্কে সম্যক ধারণার জন্য বিশে^র অন্যান্য আরও ৬টি শ্রেষ্ঠ ভাষণের তুলনামূলক আলোচনা উপস্থাপন করা হলো-
১. বিট্রিশ পরাধীনতা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে পেট্রিক হেনরি ১৭৭৫ সালের ২৩ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় ‘আমাকে স্বাধীনতা দাও, নয়তো মৃত্যু’- এই স্লোগানে ভাষণ দিয়েছিলেন। তার    স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল।     
২. রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের অবসান ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকল্পে আব্রাহাম লিংকন ১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের গেটিসবার্গ, পেনসেলভেনিয়ায় ‘জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা সরকার এবং জনগণের জন্য সরকার’- এই স্লোগানে ভাষণ দিয়েছিলেন। তার    অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল।
৩. জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার লক্ষ্যে উইনস্টন চার্চিল ১৯৪০ সালের ১৩ মে যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্সে, ‘দেওয়ার মতো কিছু নেই আমার। আছে শুধু রক্ত, কষ্ট, অশ্রু আর ঘাম’- এই স্লোগানে ভাষণ দিয়েছিলেন। তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল।          
৪. বিট্রিশবিরোধী অহিংস সংগ্রামের লক্ষ্যে মহাত্মা গান্ধী    ১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট ভারতের মুম্বাই গাওলিয়া ট্যাক ময়দানে ‘ভারতবর্ষ থেকে চলে যাও’- এই স্লোগানে ভাষণ দিয়েছিলেন।  তার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল।    
৫. বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের লক্ষ্যে নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৫৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর আফ্রিকার    ন্যাশনাল কংগ্রেসে ‘স্বাধীনতা অর্জনের কোন সহজ পথ নেই’ - এই স্লোগানে ভাষণ দিয়েছিলেন।    তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল।
৬. বৈষম্যের অবসান এবং কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার অর্জনকল্পে মার্টিন লুথার কিং ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে ‘আমি সেই স্বপ্ন দেখি —-’ - এই স্লোগানে ভাষণ দিয়েছিলেন। তার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল।    
৭. স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে (পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে) শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ     বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান) ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ - এই স্লোগানে ভাষণ দিয়েছিলেন। তার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল।    
উক্ত ভাষণগুলো যুগসন্ধিক্ষণে দেশ ও জাতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের সহায়ক হিসাবে কাজ করেছে। ভাষণগুলো জনমনে জাগরণ সৃষ্টি করে, যা যুগের দাবির আবর্তে সৃষ্টি হয় এবং স্থান, কাল ও জনগোষ্ঠীভেদে বিশ^ব্যাপী নন্দিত হয়েছে। ভাষণগুলোর সংক্ষিপ্তসার সংঘটিত হওয়ার কাল অনুসারে তুলে ধরা হলো-
যখন আমেরিকায় বিট্রিশ আধিপত্য অসহনীয় হয়ে ওঠে এবং সবকিছুতেই বিট্রিশরা নাক গলাতে থাকে তখনই অর্থাৎ, ২৩ মার্চ ১৭৭৫ ভার্জিনিয়ার একটি চার্চের আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে স্থানীয় জনগণের উপস্থিতিতে স্বাধীনতার জন্য জ্বালাময়ী ভাষণের এক পর্যায়ে পেট্রিক হেনরি বলেছিলেন ‘আমাকে স্বাধীনতা দাও, নয়তো মৃত্যু।’ তার এ ভাষণটি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে যিনি স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন, তিনি হলেন গণতন্ত্রের ধারক-বাহক আব্রাহাম লিংকন। উল্লেখ্য, জুলাই ১৮৬৩ পেনসেলভেনিয়ার গেটিসবার্গে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে প্রায় আট হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে এবং তাদের স্মরণে নির্মিত হয় একটি স্মৃতিসৌধ। এ দুঃখজনক স্মৃতির স্মরণে ১৯ নভেম্বর ১৮৬৩ আব্রাহাম লিংকন ২৭২ শব্দসম্বলিত ৩ মিনিটের একটি ভাষণ দেন। উক্ত ভাষণের নির্যাস ছিল মাত্র তিনটি ছোট বাক্য, ‘জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা সরকার এবং জনগণের জন্য সরকার।’ সে ভাষণ এখনো সারা বিশে^র মানুষের হৃদয়ে জাজ্বল্যমান। যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বর্ণাঢ্য জীবনে অনেক বক্তব্য প্রদান করলেও ১৩ মে ১৯৪০ ভাষণটি ছিল যেমন সময়োপযোগী, তেমনই তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে জার্মানির আগ্রাসী ভূমিকা একের পর এক কালো ছায়ায় দেশটিকে ঘিরে ফেলতে থাকে। দূরদর্শী ও বিচক্ষণ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল অবস্থার প্রেক্ষাপটে হাউস অব কমন্সে সরাসরি জার্মানির বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘এ মুহূর্তে দেওয়ার মতো কিছুই নেই আমার। আছে শুধু রক্ত, কষ্ট, অশ্রু আর ঘাম।’
প্রখর মেধাসম্পন্ন মহাত্মা গান্ধী, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে উপলব্ধি করেন, ‘পরাধীন জাতির মেরুদণ্ড বাঁকা থাকে, তারা কখন কোন দিক দিয়ে মাথা উঁচু করে ভাগ্যের উন্নয়ন করবে তা জানে না।’- সেই দর্শন ও অহিংস নীতিকে সামনে রেখে তিনি ৮ আগস্ট ১৯৪২ মুম্বাইয়ের গাওলিয়া ট্যাক ময়দানে ব্রিটিশদের প্রতি অবিলম্বে ‘ভারতবর্ষ থেকে চলে যাও’- স্লোগান শীর্ষক একটি যুগান্তকারী ভাষণ দেন, যা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার এবং সংগ্রাম করতে গিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলাকে একনাগাড়ে দীর্ঘ ২৮ বছর কারাবরণ করতে হয়েছিল। এ প্রেক্ষাপটে ২১ আগস্ট ১৯৫৩ আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে যে ভাষণ তিনি দিয়েছিলেন, তা ছিল বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এক অনবদ্য সৃষ্টি। যার মর্মার্থ হলো, ‘স্বাধীনতা অর্জনের কোনো সহজ পথ নেই।’  বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং ২৮ আগস্ট ১৯৬৩ ওয়াশিংটন শহরে বিশাল জনসভায় প্রদত্ত ভাষণের এক পর্যায়ে বলেন, ‘কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর যত ধরনের জোর, জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন ও বাধা আসুক না কেন আমি স্বপ্ন দেখি একদিন এই জাতি জাগ্রত হবে এবং সব মানুষের কাছে মূল্যায়িত হবে, কেননা সব মানুষ জন্মসূত্রে সমান।’
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব বহুমাত্রিক। উক্ত ভাষণে তিনি একটি জাতি গঠন প্রক্রিয়ার পূর্ণতা, জাতির আশা-আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন-সংগ্রাম-চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি যেমন সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছেন তেমনি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য, অতীত বর্তমান-ভবিষ্যৎকে একইসূত্রে গ্রথিত করেছেন। ভাষণের শেষ পর্যায়ে বলেন-‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। উপরন্তু এ ভাষণের মাধ্যমে তিনি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন এবং নিরস্ত্র বাঙালি জাতিতে স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর করে তুলেছেন। শুরু হয় স্বাধীনতা সংগ্রাহের চূড়ান্ত প্রস্তুতি।
এটা সত্য যে, ৭ মার্চের ভাষণে বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য অনেকটাই জীবন্ত হয়ে উঠেছে সকলের চোখের সামনে। এ ইতিহাস বাংলা ও বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি, আত্মপরিচয় ও স্বাধীনতা সংগ্রামের। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের ফলে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়। এরপর ঘটনার পরম্পরায় বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। ধারাবাহিক আন্দোলনের এক পর্যায়ে  শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে ৬ দফা ঘোষণা, ১৯৬৯ গণ-অভ্যুত্থান এবং ৭ মার্চ ১৯৭১ রেসকোর্স ময়দানে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এ প্রসঙ্গে ১৯৭১ সালে জুলাই মাসের সাউথ এশিয়ান রিভিউ (South Asian Review) জার্নালে উল্লেখ করা হয়- ‘বিচারকের অনুসরণ করে পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনের কর্মচারীরা যখন মুজিবের প্রতি সমর্থন জানায় তখনই বাংলাদেশের ভেতরে ক্ষমতা কার্যত হস্তান্তর হয়ে যায় এবং ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্তের এক সপ্তাহের মধ্যে তা ঘটে। পরের তিন সপ্তাহে মুজিবের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি কার্যত বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েটে পরিণত হয়।’
অবশেষে ২৬০ দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান ও অপরিসীম ত্যাগের বিনিময়ে বাংলার জনগণ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটান স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির। উল্লেখ্য, এ ভাষণটি ৩০ অক্টোবর ২০১৭ ইউনেস্কো ডকুমেন্টারি হেরিটেজ (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দি ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’এ অন্তর্ভুক্ত করেছে।
লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×