
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সামাজিক লেনদেন আর দায়িত্ব পালনে নানা ভুল বুঝাবুঝির শেষ নেই। অনেক ক্ষেত্রে স্বার্থ অন্ধ হয়ে মানুষ ন্যায়-অন্যায় ভুলে যায়, সামান্য স্বার্থের বিনিময়ে বিরাট নৈতিক পরাজয় মেনে নেয়, দুনিয়ার বদলায় আখিরাতকে বিকিয়ে দেয়। এ থেকে সজাগ সচেতন হওয়ার জন্য ধর্মীয় মূল্যবোধগুলো বারবার মানুষের সামনে সত্যিকারের পরিণাম ব্যাখ্যা করে। কুরআন ও হাদিস এ ধরনের শিক্ষায় ভরপুর। পবিত্র কুরআনের সুরা আনফালের আয়াত ও মর্মার্থগুলো আমাদের কর্মজীবনের নৈতিক উন্মেষ ঘটানোর জন্য বেশ উপযোগী বলে মনে করি। এখানে রয়েছে আনুগত্যের শিক্ষা, পারস্পরিক ভালোবাসা আর হামদর্দির তাগিদ, আল্লাহতে পূর্ণ তাওয়াক্কুল বা ভরসা স্থাপনের সবক। এ সুরার প্রথম চার আয়াতে বলা হয়েছেÑ
১. ওহে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে গণীমত বা যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদের হুকুম সম্পর্কে। বলুন : গণীমতের মাল হলো আল্লাহ এবং রাসুলের। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং নিজেদের অবস্থা সংশোধন করে নাও। আর আল্লাহ ও তার রাসুলের হুকুম মান্য কর।-যদি ইমানদার হয়ে থাক।
২. যারা ইমানদার তারা এমন যে, যখন আল্লাহর নাম নেয়া হয় তখন ভীত হয়ে পড়ে তাদের অন্তর। আর যখন তাদের সামনে পাঠ করা হয় কালাম (কুরআনের আয়াত) তখন তাদের ইমান বেড়ে যায় এবং তারা স্বীয় পরওয়ারদিগারের প্রতি ভরসা পোষণ করে।
৩. (আর) সে সমস্ত লোক যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি তাদের যে রুজি দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে।
৪. তারাই হলো সত্যিকারের ইমানদার। তাদের জন্য রয়েছে স্বীয় পরওয়ারদিগারের নিকট মর্যাদা, ক্ষমা এবং সম্মানজনক রুজি।
প্রথম আয়াতটি বদর যুদ্ধে সংঘটিত একটি ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ঘটনাটি হলোÑ ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধে বিজয় লাভের পর মুসলমানরা বেশকিছু যুদ্ধলব্ধ মালামাল অর্জন করে। কিন্তু মতপার্থক্য দেখা দেয় এসবের বিলি-বণ্টন আর গ্রহণের মধ্যে। তাই সাহাবীরা রাসুলকে (স.) প্রশ্ন করেন কিভাবে তা বণ্টন করা হবে এবং তা বণ্টনের ক্ষেত্রে কার হুকুম বা কর্তৃত্ব থাকবে? এ সময় রাসুলকে (স.) আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বলা হলোÑ আপনি তাদের বলে দিন যে, গণীমতের মাল নিয়ে মতপার্থক্যের কোনো প্রয়োজন নেই। এই সম্পদ আল্লাহ এবং তার মহান পয়গাম্বরের আওতাধীন। আল্লাহর পক্ষ থেকে মহানবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফাই (স.) একমাত্র এর হাকিম বা বিচারক। এ ব্যাপারে তার মতই চূড়ান্ত। একটি সূত্রে বর্ণিত আছেÑ মহানবী (স.) এ শর্ত প্রদান করেছিলেন যে, যে ব্যক্তি আজকের দিনে কঠিন বিপদের সম্মুখীন হবে তথা বীরত্ব প্রদর্শন করবে তাকে তিনি নফল বা নির্দিষ্ট অংশ ছাড়াও অতিরিক্ত পুরস্কার দিবেন। তাই যুবক শ্রেণি প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলেন। অতঃপর আল্লাহ যখন তাদের জন্য বিজয় সহজ করে দিলেন তখন তারা পরস্পর ইখতিলাপ করতে আরম্ভ করেন। যুবক দল বললেনÑ আমরা হলাম যোদ্ধা আর বৃদ্ধরা যারা পতাকাবাহী ছিলেন তারা বললেনÑ আমরা হলাম তোমাদের জন্য ঢালস্বরূপ...।’- (কাশশাফ)
এমতাবস্থায় তাদের ধৈর্য, শিক্ষা এবং আত্মোপলব্ধির জন্য উপরোক্ত কথাগুলো স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। অবশ্য মহানবী (স.) এসব মালামাল যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মাঝে সমানভাবে বণ্টন করে দেন-(ইবনে কাসীর)। অতঃপর সবাই আল্লাহ ও রাসুলের এই সিদ্ধান্তের ওপর রাজি হয়ে যান এবং তাদের মহান মর্যাদার পরিপন্থি পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল সে জন্য সংশ্লিষ্টরা লজ্জিত হন।-(মা’আরিফুল কুরআন)।
আয়াতগুলোতে সেসব গুণ, বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে, যা প্রতিটি মু’মিনের মধ্যে থাকা প্রয়োজন। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, প্রতিটি মু’মিন নিজের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অবস্থার পর্যালোচনা করে দেখবে। যদি তার মধ্যে এসব গুণাগুণ থাকে তাহলে আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করবে যে, তিনি তাকে মু’মিনের গুণাবলিতে সৌভাগ্যমণ্ডিত করেছেন। আর যদি এগুলোর মধ্যে কোন একটি গুণ তার মধ্যে না থাকে কিংবা থাকলেও তা একান্ত দুর্বল মনে হয় তাহলে তা অর্জন করার কিংবা তাকে সবল করে তোলার প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করবে।
আয়াতে প্রথম বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে বলা হয়েছেÑ ‘তাদের সামনে যখন আল্লাহর আলোচনা করা হয়, তখন তাদের অন্তর আতকে উঠে।’ অর্থাৎ তাদের অন্তর আল্লাহর মহত্ত্ব ও প্রেমে ভরপুর-যার দাবি হলো ভয় ও ভীতি। এ ‘ভয়’ কিন্তু সাধারণ ভয় নয়। এখানে ভয় বুঝাতে ‘খাউফ’ শব্দ ব্যবহার না করে ‘ওয়াজাল’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ এমন ভয়-যা বড়দের মহত্ত্বের কারণে মনের মধ্যে সৃষ্টি হয়। হযরত উম্মে দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এর অর্থ খেজুরের ডালপালা দাহন করার ন্যায় জ্বালাপোড়া অনুভব করা। তিনি জনৈক প্রশ্নকারীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি কি কোনো ধরনের জ্বালা অনুভব কর? বললেন হ্যাঁ! উম্মে দারদা এবার বললেন, তাহলে তুমি আল্লাহর নিকট দোয়া কর। কেননা দোয়া ওটাকে বিদুরিত করে দেয়। অর্থাৎ, আল্লাহর নাম উল্লেখ করা হলে মু’মিনের অন্তর বিচলিত হয়ে ক্ষেপে উঠে, তার বড়ত্ব ও মহত্ত্বের সম্মানে, তার পাকড়াও আর আযাবের ভয়ে।-(আহমদ)।
মু’মিনের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তার সামনে যখন আল্লাহ তায়ালার আয়াত পাঠ করা হয় তখন তার ইমান বৃদ্ধি পায়। সমস্ত আলিম তাফসিরবিদ ও হাদিসবিদগণের সর্বসম্মত মতে, ইমান বৃদ্ধির অর্থ হলো ইমানের শক্তি, অবস্থা এবং ইমানি জ্যোতির উন্নতি। আর একথা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রমাণিত যে, সৎকাজের দ্বারা ইমানি শক্তি এবং এমন আত্মিক প্রশান্তি সৃষ্টি হয় তাতে সৎকর্ম মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। তখন তা পরিহার করতে গেলে খুবই কষ্ট হয় এবং পাপের প্রতি একটা প্রকৃত ঘৃণার উদ্ভব হয়। যার ফলে সে তার কাছেও যেতে পারে না।
হযরত আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘ইমানের মোট ৭৭টি শাখা রয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ শাখা হলো এই সাক্ষ্য দেয়া যে, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই’ আর নিম্নস্তরের শাখা হলো রাস্তা-ঘাট থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা এবং লজ্জাবোধ ইমানের একটি শাখা।’-(মিশকাত)। হযরত উমর বিন আবদুল আজিজ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইমানের কতগুলো সুন্নত, ফরজ ও বিধি-বিধান রয়েছে যে ব্যক্তি এর সব পূর্ণাঙ্গরূপে পালন করে সে পূর্ণাঙ্গ ইমান লাভ করল। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি সে বিষয়গুলো যথাযথভাবে পালন করল না, সে পরিপূর্ণ ইমান লাভে ব্যর্থ হলো।-(কাশশাফ)। মু’মিনের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘তারা আল্লাহ তা’য়ালার ওপর ভরসা করবে।’ অর্থাৎ তারা তাদের সমস্ত কর্মভার তাদের রব ছাড়া অন্য কারো ওপর সোপর্দ করে না। সমস্ত আশা আর আস্থার কেন্দ্রবিন্দু তিনিই। চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হলো, নামাজ প্রতিষ্ঠা করা। এর মমার্থ হচ্ছে নামাজের যাবতীয় আদব-কায়দা, রীতি-নীতি ও শর্তাশর্ত এমনভাবে সম্পাদন করা যেমন করে নবী করীম (স.) স্বীয় কথা ও কর্মের মাধ্যমে বাতলে দিয়েছেন। নামাজের বরকত এবং কল্যাণলাভ করতে হলে নিছক যেনতেনভাবে নামাজ পড়লে হবে না। একে অবশ্যই প্রতিষ্ঠা করতে হবে সমুদয় নিয়ত ও আন্তরিকতা দিয়ে। পঞ্চম বৈশিষ্ট্যে বলা হয়েছে, আল্লাহ মু’মিনকে যে রিযিক দান করেছেন, তা থেকে আল্লাহর রাস্তায় খরচ করবে। আল্লাহর রাহে ব্যয় করার অর্থ ব্যাপক। এতে শরিয়ত নির্ধারিত যাকাত-ফিতরা প্রভৃতি, নফল দান খয়রাত সহ মেহমানদারি, বড়দের কিংবা বন্ধু বান্ধবদের প্রতি কৃত আর্থিক সাহায্য-সহায়তা প্রভৃতির সব রকমের দান-খয়রাতই অন্তর্ভুক্ত।
মু’মিনের এই ৫টি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করার পর বলা হয়েছে, উলা-য়িকা হুমুল মু’মিনুন হাক্কাÑ এমন সব লোকই হলো সত্যিকারের মু’মিন যাদের ভেতর ও বাহির একরকম এবং মুখ ও অন্তর ঐক্যবদ্ধ। এরপরে মু’মিনদের জন্য তিনটি বিষয়ের ওয়াদা করা হয়েছে। (১) সু উচ্চ মর্যাদা (২) মাগফিরাত বা ক্ষমা এবং (৩) সম্মানজনক রিজিক। এখানে মু’মিনের যে পাঁচটি গুণ ও বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোও তিনরকম। (ক) সে সব বৈশিষ্ট্য যার সম্পর্ক অন্তর ও অভ্যন্তরের সঙ্গে। যেমনÑ ইমান, খোদাভীতি, আল্লাহতে তাওয়াক্কুল (খ) যার সম্পর্ক দৈহিক কার্যকলাপের সঙ্গে। যেমনÑ নামাজ (গ) যার সম্পর্ক ধন-সম্পদের সঙ্গে। যেমনÑ আল্লাহর পথে ব্যয় করা।-(বাহরে মুহিত)।
বৈশিষ্ট্যগুলোর সঙ্গে পুরস্কারগুলোর মিলও এভাবে পাওয়া যায়। যেমন- আত্মিক কর্মের জন্য রয়েছে, সুউচ্চ মর্যাদা, দৈহিক কর্মের জন্য মাগফিরাত এবং সম্মানজনক জীবিকার ওয়াদা দেয়া হয়েছে আল্লাহর রাহে ব্যয় করার জন্য।
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব
[email protected]