
অর্থনীতি শাস্ত্রের দৃষ্টিতে ব্যাংক খাতে উচ্চ খেলাপি ঋণ ও নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি একটি দেশের অর্থনীতিতে নানাবিধ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে পুরো অর্থব্যবস্থাকে একটি পাকচক্রে ফেলে। যেমনÑ খেলাপি ঋণ বাড়লে ব্যাংকের মুনাফা কমে যায়। ফলে নতুন বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি হয়। এতে করে নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি ব্যাংকের স্থিতিশীলতা দুর্বল করে দেয়। ফলে আর্থিক সংকটের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এই দুইয়ের এহেন অবস্থায় ব্যাংকের প্রতি আমানতকারীদের আস্থা কমে যায় এবং ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলনের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এটি আবার তারল্য সংকট সৃষ্টি করে। সব মিলিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে উচ্চ ঋণ খেলাপি হার ও তীব্র নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রমে অনিশ্চয়তা বয়ে আনে, যা বিনিয়োগ কমিয়ে অর্থনীতিকে ক্রমশ স্থবির করতে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, দেশের ব্যাংকগুলোর ২০২৪ সালের আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্তকরণ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরীক্ষা দলের পরিদর্শন কাজ শেষ হলে খেলাপি ঋণ পরিমাণ ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতের ১২টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়া ও আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়ে অডিট কাজ শেষ হলে খেলাপি ঋণের হার ৩৫ শতাংশের বেশি হবে এবং তা ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশে গত দেড় যুগ ধরে চলা স্বজন তুষ্টিবাদী ও তথাকথিত গণতান্ত্রিক শাসনামলে বিশৃঙ্খল পরিচালনা ব্যবস্থাই ব্যাংক খাতের আজকের ভঙ্গুর অবস্থার জন্য মূলত দায়ী। ক্ষমতার আশপাশে থাকা ধনিক শ্রেণির লোকজন নামে-বেনামে ঋণ নিয়েছে, যার কিয়দংশ তার উচ্চ মহলকে ঘুষ হিসেবে প্রদান করেছে। ঘুষ গ্রহণকারী মহল আবার অবৈধ সেসব অর্থ বিদেশে পাচার করে বিদেশ-বিভুঁইয়ে অর্থবিত্তের পাহাড় গড়েছে। রাজনীতিবিদ-আমলা-ব্যবসায়ীদের ত্রিভুজ এক চক্র নিজেদের মধ্যে গোপন শলাপরামর্শ ও যোগসাজশ করেই এসব অপকর্ম সমাধা করেছে এবং দেদার ব্যাংক খাত থেকে লাখো-কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এসব মন্তব্য-অভিমত নিয়ে কারও মধ্যে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই। তবু এখানে বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার যে, বিশ^ব্যাংক-আইএমএফ-আইডিবি ও তথাকথিত দাতা সংস্থার লালিত-পালিত পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়া খুব স্বাভাবিক এক প্রবণতা। এই অভিমতের পক্ষে যেসব জোরালো ও গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি রয়েছে, তার মধ্যে কয়েকটি সবার অবগতির জন্য আলোচনা করা দরকার। কারণ, সরকার আসবে, সরকার যাবে; কিন্তু পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত ‘শয়তানি’র কথা মনে না রাখলে আবারও বাংলাদেশকে উচ্চ খেলাপি ঋণের বোঝা নিয়ে হাপিত্যেশ করতে হবে। পুঁজিবাদ ঋণ নিয়ে মেরে দেওয়া স্বাভাবিক প্রবণতা তত্ত্বের পক্ষে অন্যতম যুক্তি হচ্ছেÑ
১. ঝুঁকি ও মুনাফার অনিবার্যতা : পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিনিয়োগ ও ঋণপ্রদানের ভিত্তি হলো ঝুঁকি ও মুনাফা। ব্যবসায় লাভ-ক্ষতির চক্র রয়েছে, যেখানে কিছু ঋণ স্বাভাবিকভাবেই খেলাপিতে পরিণত হয়। ব্যাংকও ঝুঁকি বিবেচনা করেই ঋণ প্রদান করে। তাই খেলাপি ঋণ পুঁজিবাদী কাঠামোরই অংশ।
২. বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সুবিধা : অনেক করপোরেট প্রতিষ্ঠান উচ্চ মূলধন ও প্রভাবের কারণে ঋণ নিয়ে ফেরত না দিলেও তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই তারা পুনঃতফসিল বা বেইল আউট সুবিধা পেয়ে যায়। যা প্রমাণ করে যে খেলাপি ঋণ পুঁজিবাদে সাধারণ ঘটনা।
৩.অর্থনৈতিক প্রবাহ ও উদ্ভাবন : নতুন উদ্যোগের জন্য ঋণ নেওয়া হয়, কিন্তু সব ব্যবসা সফল হয় না। ব্যর্থ উদ্যোগগুলো খেলাপি ঋণের হার বাড়ালেও অর্থনীতির উদ্ভাবনী শক্তিকে অব্যাহত রাখে, যা পুঁজিবাদে স্বাভাবিক হিসেবে গণ্য করা হয়।
৪. রাষ্ট্রীয় নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব : অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও নীতিগত সুবিধার কারণে বড় ঋণগ্রহীতারা ঋণ পরিশোধে অবহেলা করে, অথচ রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের রক্ষা করা হয়। ফলে এটি পুঁজিবাদী কাঠামোর একটি নিয়মিত চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই যুক্তিগুলো দেখায় যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার প্রবণতা শুধু বাস্তবতা নয়, বরং কাঠামোগতভাবেও এটি এক ধরনের স্বাভাবিক ঘটনা। এ জন্যই বলা হয়, পুঁজিবাদী অর্থনীতি ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি ঋণচক্রের কারণে ৪০-৫০ বছর পরপর মহামন্দা ঘটতে বাধ্য। তবে নানা কারণে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক অর্থনীতির এই মন্দা ও মহামন্দার সময়কাল এখন আরও কমে এসেছে। আর এর কারণ হচ্ছে, আজকের যুগের পুঁজিবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আর্থিকীকরণকৃত পুঁজিবাদে মেগা করপোরেশন ও মেগা ব্যাংক সরকারের কাছ (সরকার আসলে বায়বীয় সত্তা, আদতে জনগণের অর্থ) থেকে সস্তায় ঋণ নেবে; কিন্তু কখনো তা ফেরত দেবে না। এরা দেওলিয়া হওয়ার ভাব দেখাবে, ফলে অর্থনীতিতে মন্দা আসবে। সরকার এদের উদ্ধারের নামে আরও সস্তা ঋণ দিয়ে মেগা করপোরেশন ও মেগা ব্যাংককে রক্ষা করবে, যারা আবারও ঋণ নেবে এবং আবারও ফেরত দেবে না। এভাবে এই দুষ্টচক্র চলতেই থাকবে।
অর্থনীতির এই মৃত্যুদশার কারণ কোনো দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেলে তার কান্ট্রি রেটিং বা সার্বভৌম ঋণমান কমে যায়। অর্থাৎ ঋণমান নেতিবাচক হওয়ায়, বিদেশী ঋণের সুযোগ সীমিত হয়ে যায়। এ জন্যই বিদেশী ব্যাংকগুলো অনেক আগেই বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর ক্রেডিট লিমিট বা ঋণসীমা কমিয়ে দিয়েছে। সামনের দিনে খেলাপি ঋণ ৩০-৩৫ শতাংশ হলে বাংলাদেশের ব্যাংক ও উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠানের ঋণ পাওয়া আরও কমে যাবে। ফলে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট তীব্র হবে। ফলে এলসি দায় পরিশোধও কঠিন হবে। এ অবস্থায় সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। আর সরকার বিদেশী ঋণ না পেলে, হয়তো বাধ্য হয়ে টাকা ছাপাবে, অথবা উচ্চ সুদে আরও ঋণ নেবে। সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে আরও অস্থিরতা দেখা দেবে। আমরা জানি, অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী, উচ্চ খেলাপি ঋণের ফলে অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতের ওপর বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যেমনÑ প্রথমত, ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা নষ্ট হয় খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি হলে। অর্থাৎ ব্যাংকের মূলধন কমে যায় এবং তারল্য সংকট তৈরি হয়, যা ব্যাংকের কার্যক্রমকে ব্যাহত করতে থাকে। দ্বিতীয়ত, ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি পায়। ফলে ব্যাংকগুলো ঝুঁকি কমানোর জন্য ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দেয়, যা বিনিয়োগ ও ব্যবসায়িক সম্প্রসারণকে বাধাগ্রস্ত করে। তৃতীয়ত, ব্যবসায়িক আস্থা কমে যায়। ফলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাজারকে অনিরাপদ মনে করে এবং বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। চতুর্থত, সাধারণ জনগণের ওপর চাপ বৃদ্ধি পায় এবং ব্যাংকগুলো ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সাধারণ জনগণের আমানতের সুদ কমিয়ে দেয় এবং ব্যাংকিং পরিষেবার ব্যয় বাড়িয়ে দেয়, যা আমানতকারীদের জন্য আরও ক্ষতির কারণ হয়। এসবের প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এর কারণ হচ্ছে, ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের কারণে নতুন বিনিয়োগে উৎসাহ হারায়। ফলে শিল্প ও ব্যবসার সম্প্রসারণ বাধাগ্রস্ত হয় এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যায়। আর ব্যাংকিং খাত দুর্বল হলে সরকারের কর আদায়ও কমে যায়, যা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, যা মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক সংকট বাড়াতে থাকে।
এমন এক প্রেক্ষাপটে সবদিক পর্যালোচনা করে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকে সুসংগঠিত ও খেলাপি ঋণের সংকট থেকে মুক্ত করতে কৌশলগত ও বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। পুঁজিবাদী অর্থনীতির বাস্তবতা মেনে নিয়ে অন্যান্য দেশের শিক্ষা কাজে লাগিয়ে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের দিকে এগোতে হবে। যার মধ্যে রয়েছেÑ প্রথমত, কঠোর ঋণ অনুমোদন নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। ব্যাংকগুলোকে রাজনৈতিক বা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর চাপ উপেক্ষা করে আর্থিক সক্ষমতার ভিত্তিতে ঋণ অনুমোদন করতে হবে। ঋণগ্রহীতার অতীত লেনদেন বিশ্লেষণ ও জামানতের যথাযথ নিশ্চয়তা নিশ্চিত করা উচিত। দ্বিতীয়ত, ঋণ আদায়ের কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। দ্রুত ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন, জামানতকৃত সম্পদের দ্রুত বিক্রি এবং পুনঃতফসিলের নিয়ম কঠোর করা প্রয়োজন। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের সুবিধা বন্ধ করে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের সহায়তা দেওয়া উচিত। তৃতীয়ত, ব্যাংক তদারকি ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি ক্ষমতা বাড়িয়ে নিয়মিত নিরীক্ষা চালু করা ও ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে জবাবদিহি নিশ্চিত করা দরকার। দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা যেতে পারে। চতুর্থত, ঋণ খেলাপিদের জন্য কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের ব্যাংক ঋণ সুবিধা বন্ধ, বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা এবং সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার মতো ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। পঞ্চমত, ব্যাংকগুলোতে কর্পোরেট সুশাসন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করে যোগ্য ও দক্ষ নির্বাহীদের নিয়োগ দেওয়া উচিত। ঋণের বিপরীতে যথাযথ জামানত ও ঝুঁকি বিশ্লেষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ষষ্ঠত, অলস ও অবলোপনকৃত ঋণ পুনরুদ্ধারে বিশেষ ইউনিট গঠন এবং ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ কেনাবেচার জন্য মাধ্যমিক বাজার তৈরি করা যেতে পারে। সপ্তমত, ডিজিটাল ও স্বয়ংক্রিয় ঋণ ব্যবস্থাপনা চালু করা দরকার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ঋণগ্রহীতার ঝুঁকি বিশ্লেষণ করলে খেলাপি ঋণ কমে আসবে। অষ্টমত, ঋণ সংস্কৃতি পরিবর্তন ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। জনগণকে ঋণের যথাযথ ব্যবহার ও পরিশোধের বিষয়ে সচেতন করা এবং উদ্যোক্তাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।
উল্লিখিত বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার আলোকে পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট ও ব্যাংকিং খাতের বেহাল দশা থেকে মুক্তি পেতে হলে অতীতে যা হয়ে গেছে, তা যেন ভবিষ্যতে যতটা সম্ভব এড়ানো যায়, তার কার্যকর উপায় বের করতে হবে। এ জন্য সমন্বিত নীতি গ্রহণের পাশাপাশি ব্যাংকিং সংস্কৃতির পরিবর্তন এবং প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করাই হবে টেকসই সমাধানের মূল চাবিকাঠি।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়