
‘মব ভায়োলেন্স হলো এমন এক ধরনের সহিংসতা যেখানে সাধারণ মানুষ নিজেদের মধ্যে সংঘবদ্ধ হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। এটি সাধারণত উস্কানি, গুজব, বাভুল তথ্যের কারণে ঘটে এবং প্রায়ই অপরাধী সন্দেহে নির্দিষ্ট ব্যক্তির ওপর আক্রমণ চালানো হয়। সা¤প্রতিক সময়ে আমরা অনেকবার এমন ঘটনার সাক্ষী হয়েছি। যেমনÑ চুরির অভিযোগে জনতার হাতে কাউকে পিটিয়ে হত্যা।
আমরা বলছি স্বৈরাচারী শাসকের পতন ঘটিয়ে শোষণমুক্ত দেশ প্রতিষ্ঠা করেছি, কিন্তু গণপিটুনি এবং কিছু গুটিকয়েক মানুষের অতি উৎসাহী আচরণআমাদেও হাজারো প্রাণের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত প্রাপ্তিকে ছোট ও কলঙ্কিত করার চেষ্টা করছে এবং প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। সময়টি দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু কিছু মানুষ এর উল্টো পথে ছুটছে। সমগ্র দেশবাসী যখন দেশ সংস্কার ও নিজেকে বদলানোর প্রচেষ্টায় ব্যস্ত, ঠিক সেই সময়ে কিছু মানুষ হায়েনার মতো আচরণ করছে। এমন আচরণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। কারণ একজন মানুষের জন্য সমগ্র জাতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কোনো সুযোগ নেই।
এজন্য আমাদের উচিত, এমন বিকৃত মানসিকতার মানুষকে সামাজিকভাবে তার ভুলগুলো সম্পর্কে সচেতন করা, তাকে এসব কাজ থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করা এবং এর ফলে সৃষ্ট সমস্যা ও ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে তাকে অবগত করা। সেই সঙ্গে কৃতকর্মের জন্য তাকে আইনের আওতায় আনা। এছাড়াও মসজিদ, মন্দির ও অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় আইনে এর শাস্তি সম্পর্কে আলোকপাত করা উচিত; যেমনÑ ইমাম, পুরোহিত, পাদ্রী, ভিক্ষুগণ ধর্মীয় আলোচনার সঙ্গে বাংলাদেশের আইনের শাস্তি সাধারণ মানুষকে জানাবেন। সুশীল সমাজ, স্থানীয় সমাজ কমিটি এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গকে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে।
সা¤প্রতিক বছরগুলোতে আমরা দেখেছি যে অনলাইন মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হয়েছে এবং অনেকেই তা যাচাই না করেই বিশ্বাস করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালে শিশু চুরির গুজব ছড়িয়ে কিছু মানুষকে গণপিটুনির শিকার হতে হয় এবং এতে অনেক নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারায়। এমন ঘটনা আমাদের নৈতিকতা এবং সামাজিক শৃঙ্খলার ওপর প্রভাব ফেলছে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণার মাধ্যমে এ ধরনের গুজব দ্রæত ছড়ায় এবং এটি নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধিও প্রয়োজন।
অন্যদিকে আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে যে কোনো অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এসিড নিক্ষেপ মোকাবিলায় আইনপ্রয়োগের সুফল আমরা দেখেছি। দÐবিধি ১৮৬০ ও ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এ অবৈধ অনুপ্রবেশ করা, হুমকি দেওয়া এবং আত্মরক্ষার উদ্দেশ্য ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকে আঘাত করা দÐনীয় অপরাধ। যার শাস্তি অপরাধের মাত্রাভেদে মৃত্যুদÐ পর্যন্ত হতে পারে। ২০২৩ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, গুজব এবং অপপ্রচার ছড়ানোর দায়ে বেশকিছু মামলাও করা হয়েছে, যেখানে অপরাধীদের কারাদÐ এবং জরিমানার মতো শাস্তি প্রদান করা হয়েছে।
আমরা ৫ আগস্টের পর থেকে কিছু মানুষের কর্মকাÐ দেখছি জানিয়ে সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন। কারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছিলতাদেও সকলের অধিকার অক্ষুণœ রাখতে। কিন্তু আমরা যে সকল ঘটনার সাক্ষী হচ্ছি তা আমাদের উদ্দেশ্যের সাথে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিভিন্ন দলের নাম ভাঙিয়ে আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়া এবং প্রতিনিয়তই মানুষ মামলা হামলার শিকার হচ্ছে। এমনকি নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে।
এখনই যদি এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তাহলে জাতির এই আত্মত্যাগ বৃথা যেতে পারে। তাই আমাদের উচিত সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। একইসাথে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সাইবার ক্রাইম এবং গুজব সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করে তোলা প্রয়োজন। যেন তারা ভবিষ্যতে সচেতন নাগরিক হিসেবেগড়ে ওঠে। তবেই আমাদের শহীদদের আত্মত্যাগ সার্থক হবে। অন্যথায় অর্জন রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। আমরা চাই না মারামারি, হানাহানি, অন্যায়-অত্যাচার। আমাদের স্বপ্ন হলো এমন একটি দেশ যা মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও ন্যায্যতার ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে।
লেখক : উন্নয়নকর্মী
ধৎরভপনরঁ@মসধরষ.পড়স