
বাংলাদেশ বর্তমানে একটি ভয়াবহ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, ধর্ষণ যেন মহামারির রূপ নিয়েছে। শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ এ জঘন্য অপরাধের শিকার হচ্ছে। অথচ বিচারব্যবস্থার দুর্বলতায় অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। স্টুডিওতে ছবি তুলতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার ৫ বছরের মাদ্রাসাছাত্রী, অটোরিক্সা থেকে নামিয়ে গৃহবধূকে দলবদ্ধ ধর্ষণ, চকোলেটের লোভ দেখিয়ে ৪ বছরের শিশু ধর্ষণ, ট্রলারে মাওয়া ঘাট পার হওয়ার সময় গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণÑ এসব সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ভয়ংকর চিত্র। পত্রিকার পাতা ওল্টালে এমন শত শত ঘটনা চোখে পড়ে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ১,৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৭৬ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ১০ জন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। এছাড়া প্রতিবন্ধী নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬২ জন। বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ধর্ষণের অভিযোগে ১,৫২০টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। যার মধ্যে ৭৫ জন নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ৮ জন আত্মহত্যা করেছেন। ২০২৫ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রæয়ারি মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা আরও উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। জানুয়ারিতে ১১২টি ধর্ষণের ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে, যার মধ্যে ৬ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনগুলো নারী ও শিশু নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ৯(১) ধারা অনুযায়ী ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদÐ, যা ২০২০ সালে সংশোধনের মাধ্যমে মৃত্যুদÐ করা হয়েছে। তবুও ধর্ষণের হার প্রতিনিয়ত বাড়ছে, কমছে না। তবে কি উক্ত আইন শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ? বিচারহীনতার সংস্কৃতি এর অন্যতম প্রধান কারণ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্ষণের মামলাগুলো দীর্ঘসূত্রতার কারণে বছরের পর বছর ঝুলে থাকে। দেশে ৯৫টি ট্রাইব্যুনালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে প্রায় পৌনে দুই লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার মামলা ৫ বছরেরও বেশি পুরনো। ফলে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কঠোর শাস্তির বিধান নিশ্চিত করাটাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরের পর বছর ঝুলে থাকা মামলার গøানি টানতে গিয়ে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, তা অনেক ভুক্তভোগীর পক্ষে বহন করা সম্ভব হয় না।
পারিবারিক ও নৈতিক শিক্ষা এবং সামাজিক মূল্যবোধের অভাব, ইন্টারনেটের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ও পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতায় বিকৃত মনমানসিকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া ক্ষমতাসীনদের আধিপত্য এবং রাজনীতিবিদদের দৌরাত্ম্যও চোখে পড়ার মতো। ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার মতে, প্রতি ১০০টি ঘটনার মধ্যে প্রায় ৩০টি ঘটনাই রিপোর্ট হয় না। কারণ খুঁজলে দেখা যায়, ভুক্তভোগী মামলা করার পর অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তি-নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রভাবশালী ও রাজনীতিবিদদের দৌরাত্ম্যের ভয়ে মামলা করতেই ভয় পান। যেই সমাজে ন্যায়বিচারের চাবি শক্তিশালীদের হাতে, সেখানে সত্য কেবল কান্নার ভাষায় কথা বলে। অনেক সময় পুলিশ মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে মামলা নেয় না বা সুষ্ঠু তদন্ত করে না। নিউজ মিডিয়াগুলোর সঠিকভাবে রিপোর্টিং না করা, অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পরে অপরাধীকে প্রশ্ন না করে শুধু ভুক্তভোগীকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে লজ্জিত করা হয়।
ধর্ষণের এই কালো থাবা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে কী কী কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে? ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি। তাই এটি রোধে সমাজ, পরিবার এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও ব্যক্তি পর্যায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এটি শুধু আইনের মাধ্যমে সমাধানযোগ্য নয়, বরং নৈতিকতা শিক্ষা ও সচেতনতার মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন আনতে হবে।
প্রথমত, আইনি প্রক্রিয়া দীর্ঘ না করে ধর্ষণের শাস্তি কার্যকর করা এবং দ্রæত বিচার নিশ্চিত করা। প্রশাসনের কেউ অপরাধীদের সঙ্গে জড়িত থাকলে তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা দেওয়া এবং আইনি সহায়তা সহজ করা। আইন অনুযায়ী অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। শিশুদের ছোটবেলা থেকেই নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে নারীদের আত্মরক্ষামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, জরুরি সহায়তা নম্বর এবং অ্যাপসেবা সহজ ও দ্রæততর করা, ইন্টারনেটের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, অবৈধ কন্টেন্ট নিয়ন্ত্রণ এবং পর্নোগ্রাফি সাইট পুরোপুরি বন্ধ করতে সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মিডিয়াগুলোকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।
মনে রাখতে হবে, যেখানে ন্যায়বিচার ঘুমিয়ে থাকে, অন্যায় সেখানে নির্লজ্জ উল্লাস করে। আর প্রতিটা নীরবতা ধর্ষকের জন্য পুরস্কার হয়ে ওঠে। তাই আমাদের সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। ধর্ষণ শুধু আইনি নয়, এটি একটি সামাজিক ও নৈতিক সমস্যা। আর এর একমাত্র সমাধান সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সম্ভব। ন্যায়বিচারের পথ সুগম না হলে ধর্ষণের ভয়াবহতা কখনোই থামবে না।
লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়