
একজন শিশু যেমন মায়ের, তেমনি বাবারও। বাবা-মা দুজনেরই দায়িত্ব সমান। শিশুর বিকাশ মূল্যায়নে মা-বাবাই শ্রেষ্ঠ বিচারক। গাছের একটি চারাকে বড় করতে হলে সেটার যেমন ভালো মাটির প্রয়োজন, পরিচর্যা করা দরকার, ঠিক তেমনি একজন শিশুকে বড় করে তুলতে হলে চাই বাবা-মা’র আদরযত্ন, উপযুক্ত পরিবেশ, শিক্ষার আলো এবং সুচিকিৎসা। শিশুর সুষ্ঠু মানসিক বিকাশের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বয়োজ্যেষ্ঠদের মনোযোগ ও ভালোবাসা। আমরা জানি, মানুষের মস্তিষ্কের বৃদ্ধি প্রায় দুই বছরের মধ্যে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। শিশুর বিকাশ বিষয়ক ডাক্তারের দেওয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এখানে সামান্য পরিসরে তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো। মানুষের পাঁচটি ইন্দ্রিয় অর্থাৎ অনুভূতি রয়েছে। এগুলো হলোÑ শ্রবণ, দৃষ্টি, ঘ্রাণ, স্পর্শ ও স্বাদ।
মানুষের জন্মমাত্রেই এই পাঁচটি ইন্দ্রিয় কাজ শুরু করে দেয়। সেই থেকে শিশু পৃথিবী সম্পর্কে জানতে শুরু করে। চিকিৎসকের ভাষায়, মানুষের কণ্ঠস্বর হলো শিশুর শোনার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধ্বনি। গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো মানুষের মুখ দেখা। কোনো অবস্থাতে শিশুকে একা থাকতে দেওয়া উচিত নয়। আজকাল অনেক শিশুর ভাগ্যে মায়ের বুকের দুধ জোটে না। তার কারণ হলো, মা জীবিকার তাগিদে চলে যায় কর্মস্থলে। শিশুর মানসিক তৃপ্তি ঘটে যখন সে তার মায়ের দুধ খাওয়ার সময় মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। শিশুর বিকাশে খেলা আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। খেলার মাধ্যমে একজন শিশুর দেহ ও মনের অনুশীলন হয়। শিশুর ভাষা, চিন্তা ও গোছানোর দক্ষতা বাড়াতে খেলার জুড়ি নেই। খেলার মাধ্যমে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বাড়ে। শিশুরা সাধারণত খেলার জিনিস ও বড়দের অনুকরণ করে চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে শুরু করে। একজন মা-ই হচ্ছে শিশুর আসল কারিগর। ঘরে যদি বাবা-মা’র মধ্যে কলহ-বিবাদ লেগে থাকে তাহলে অনাগত দিনের জন্য এই পরিস্থিতি কালো মেঘের ঘনঘটা। শিশুর বাবা-মা’র সমঝোতা, সুন্দর অনুকূল পরিবেশই শিশুকে নির্মলভাবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে।
শিশু অনুকরণ প্রিয়। কচি শিশু যখন নিজে নিজে কিছু করার জেদ ধরে তখন বাবা-মা’র বা অন্যান্য বয়োজ্যেষ্ঠদের উচিত ধৈর্য ধরা। যদি সেই জেদে বিপদের কোনো আশঙ্কা না থাকে তাহলে নতুন ও কঠিন কিছু করার জন্যে শিশুর জোর চেষ্টা তার বিকাশের ক্ষেত্রে অনুকূল ক্ষেত্র সৃষ্টি হতে বাধ্য। শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হলো ভালো-মন্দ বিভেদ করে শিশুকে ভালোর দিকে ধাবিত করানো। শিশুকে একা একা খেলতে দেওয়ার পাশাপাশি বড়দের সঙ্গেও খেলতে দেওয়া একান্ত কর্তব্য। শিশুর বিকাশে গান গাওয়া, কথা বলা, ছড়া বলা, ছেলেমানুষী খেলা করা খুবই যুক্তিযুক্ত। শিশুর বেশি খেয়াল থাকে বড়রা কি কাজে ব্যস্ত সেদিকে। শিশুদের আচার-আচরণে ও ব্যক্তিত্ব বিকাশে বড়দের কৃতকর্ম ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বেশি প্রভাব ফেলে। বড়রা যদি অন্যের প্রতি কর্কশ ভাষায় কথা বলে, জোর করে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় তখন যদি কোনো শিশু সামনে থাকে তাহলে শিশুটি ভাবতে পারে এগুলো সঠিক আচরণ। এভাবে শিশুর বিকাশে ঘটে অন্তরায়।
চার বছরের কম বয়সের শিশুরা স্বাভাবিকই আত্মকেন্দ্রিক হয়। আস্তে আস্তে অন্যদের সম্পর্কে ছোট শিশুদের আগ্রহ জন্মায় এবং তাদের সঙ্গে মেলামেশা করতে শেখে। শিশু বেড়ে ওঠার সময় যদি দেখে বড়রা অন্যদের স্বার্থকে মূল্য দেয় এবং যথাযথ কার্যাদিতে উপযুক্ত সাহায্য-সহযোগিতা করে তবে তারাও অনুরূপ আচরণ করতে শিখবে। শিশুর আবেগ অনুভূতি কখনো কখনো বড়দের নিকট অযৌক্তিক মনে হলেও তা কিন্তু অত্যন্ত বাস্তব ও জোরালো। শিশুরা সাধারণত অপরিচিত মানুষ, অন্ধকার, কোনো অদৃশ্য বস্তুর শব্দ ইত্যাদিতে ভয় পায়। এতে শিশুর মন খারাপ হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে কান্না জুড়ে দেয়। এ সময় বাবা-মা’কে শিশুর অনুভূতি বুঝতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে শিশুর প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে।
শিশুরা কখনো কখনো ভুল করে এবং অনাকাক্সিক্ষত আচরণ করে। এ সময় বুদ্ধিমানের কাজ হলো শিশুকে কাছে বসিয়ে শান্তভাবে বোঝানো। ভালো-মন্দ দিক উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া। এভাবেই শিশুর বিবেক তৈরি হয় এবং সে ভালো-মন্দের পার্থক্য সহজে বুঝতে পারে। অনেক সময় শিশুরা জোরে জোরে কান্না শুরু করে দেয়, কোনোভাবেই তাদের কান্না থামানো যায় না। এ ব্যাপারে একজন শিশু বিশেষজ্ঞ জানালেন, তিন-চার সপ্তাহ বয়সের শিশু সাধারণত এ ধরনের কান্না শুরু হয় এবং প্রতিদিনই একই নিয়মে একই সময়ে সে কাঁদে। এ ধরনের কান্না তিনমাস পর্যন্ত চলতে পারে। এ ধরনের কান্নার কারণ নাকি এখনো স্পষ্ট নয়। তবে আশার কথা হলো, এ কান্নায় শিশুর কোনো ক্ষতি হয় না।
বাবা-মা যদি শিশুর আচরণ সহজভাবে মেনে নেয় তা শিশুকে ভালো হতে প্রেরণা জোগায়। এ জন্যে শিশু ভালো কিছু করলে বাবা-মার সন্তুষ্টি প্রকাশ করা একান্ত কর্তব্য। এতে সহসা শিশুর বিকাশ ঘটে। তবে একটা কথা স্মরণে রাখা উচিত যে, শারীরিক শাস্তি শিশুর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এতে শিশুর জেদ প্রখর হয়, হিংস্র প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, লেখাপড়ার প্রতি সে বিমুখ হয়ে যায়। এমনকি শারীরিক শাস্তির কারণে অনেক ক্ষেত্রে শিশুরা বাবা-মাকে বা শিক্ষককে সন্তুষ্ট করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। স্বাভাবিক শিক্ষালাভে হয়ে পড়ে অশান্ত। তাই শিশুর সন্তুষ্টি বিধানে বাবা-মা’কে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
একজন শিশুর ইচ্ছা ও আস্থা তখনই তৈরি হয় যখন ঐ শিশু জন্ম থেকে ভালোবাসা, নিরাপত্তা ও কাজের স্বীকৃতি পায়। জীবনের প্রথম বছরগুলোতেই বাবা-মা শিশুকে স্কুলে সফল শিক্ষা লাভের ভিত তৈরি করে দিতে পারেন। বাবা-মা শিশুর খেলায় সাহায্য করতে পারেন, কিন্তু খেলা নিয়ন্ত্রণ করা মোটেও ঠিক নয়। লেখাপড়ার ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য। স্কুলে ভালো ফল করার জন্য শিশুকে বেশি চাপে রাখা উচিত নয়। এতে লাভের চেয়ে ক্ষতির পাল্লাই বেশি ভারি হবে। শিশুকে কিছু চাপিয়ে দিয়ে আদায় করা বোকামির শামিল। খুব কম বয়সে পড়া, লেখা এবং গণনা শেখানোর চেষ্টা অনেকটা দালান তৈরির মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। দালান তৈরির প্রক্রিয়ার মতোই ধাপে ধাপে শিশুর শেখার ক্ষমতা জন্মে।
শিশুরা ভিন্ন ভিন্ন বয়সে কথা বলতে শেখে। একজন শিশু ছয় বছর বয়সের মধ্যে সে ভাষার মৌলিক নিয়মকানুন শিখে ফেলে। এ বয়সে শিশুদের উৎসাহ দেওয়া একান্ত জরুরি। মেয়ে শিশু ও ছেলে শিশুর দৈহিক, মানসিক ও আবেগ-অনুভূতিগত প্রয়োজনে কোনো পার্থক্য নেই। উভয়েরই খেলার চাহিদা সমান ও সকল ধরনের শেখার ক্ষমতাও সমান। তাই শিশুর বিকাশে করণীয় কর্তব্যগুলো যদি আমরা হেলায়ফেলায় পালন না করি তাহলে শুভফল বাতুলতা মাত্র। ভালোবাসা এবং স্বীকৃতিও শিশুর বিকাশে একটা অপরিহার্য বিষয়। তাই আমাদের সকলের উচিত শিশুর বিকাশে নৈতিক দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালন করা।
লেখক : সাংবাদিক