ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৪ মার্চ ২০২৫, ২০ ফাল্গুন ১৪৩১

রমজানে স্বাস্থ্যকর খাবার

ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

প্রকাশিত: ২০:৪৩, ৪ মার্চ ২০২৫

রমজানে স্বাস্থ্যকর খাবার

স্বাস্থ্যকর খাবার

চলছে সংযমের মাস মাহে রমজান। রমজান মাসে সঠিক খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করা খুব জরুরি। কারণ, রমজানে দীর্ঘ সময় ক্ষুধার্ত থাকতে হয়। তাই এই মাসে কি খেতে হয়, কি খাওয়া উচিত নয়, সে দিকে নজর দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের দেশে রমজান মাস এলেই খাওয়া-দাওয়ার ধুম পড়ে যায়। মানুষ অস্থির হয়ে পড়ে কী খাবে, কী খাবে না এসব নিয়ে। রোজায় প্রতিদিনের খাবারের মেন্যুতে আসে ভিন্নতা, তার সঙ্গে সময়ের ব্যবধান তো রয়েছেই। আপাতদৃষ্টিতে আমাদের অনেকেরই মনে হতে পারে, রোজায় ১৪-১৫ ঘণ্টা না খেয়ে থেকে স্বাস্থ্যহানি ঘটতে পারে। তাই ইফতারে বেশি বেশি খাওয়া ভালো। রোজায় খাবারের বিরতি কম হওয়ায় প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খাওয়া হয়ে যায়। আবার অনেকেই বলেন, রোজায় খাবারের হিসাব নেই।

তাই রোজায় রকমারি খাবারের আয়োজন বেড়ে যায়, যা কি না স্বাস্থ্য উপযোগী নয়। তবে দৈনিক চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখেই খাদ্য নির্বাচন করা দরকার। রোজা পালনের জন্য প্রয়োজন সঠিক ডায়েট নির্বাচন, শারীরিক সুস্থতা, মানসিক শক্তি এবং অদম্য ইচ্ছা ও আনুগত্য। চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদদের মতে, কিছু নিয়মনীতি ও পরামর্শ অনুসরণ করলে কষ্ট ছাড়াই রোজা পালন করা যায়। বিভিন্ন দেশে ও সংস্কৃতি ভেদে রমজান মাসে সাহ্রী ও ইফতারের খাবারের ধরন ভিন্ন হয়ে থাকে।

মনে রাখতে হবে অস্বাস্থ্যকর ইফতার ও সাহ্রী নানা রোগ-ব্যাধির ঝুঁকি বাড়ায়। দিনভর রোজা রেখে শরীরে যে শক্তি ও পুষ্টির চাহিদা থাকে, তা পূরণে সাহ্রী ও ইফতারে এমন খাবার খেতে হবে যেগুলো পর্যাপ্ত প্রোটিন, কার্বোহাইডেট, ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ থাকে।

কী খাবেন ইফতারে
রোজার প্রধান আকর্ষণই হলো ইফতার। বেশিরভাগ রোজাদারের ইফতারে তেলে ভাজা ও গুরুপাক খাবারের আয়োজন থাকে। রমজান মাস এলে বিকেল থেকেই ইফতারের জন্য নানা খাবার তৈরি ও বিক্রির হিড়িক পড়ে। হরেক রকম ইফতারির পসরা সাজিয়ে দোকানিরা রাস্তার ধারে, ফুটপাতে, অলিগলিতে, হাটবাজারে সাজিয়ে রাখেন।

এসব ইফতারির মধ্যে রয়েছে ছোলা, মুড়ি, পিঁয়াজু, বেগুনি, ডালবড়া, সবজিবড়া, আলুর চপ, খেজুর, হালিম, জালি কাবাব, জিলাপি, বুন্দিয়া ইত্যাদি। আরও রয়েছে বিভিন্ন ফল ও ফলের রস, আখের গুড়ের শরবত, নানা রং মিশ্রিত বাহারি শরবত। তা ছাড়া মুখরোচক বিরিয়ানি ও তেহারি তো আছেই।
প্রশ্ন হলোÑ এসব মুখরোচক খাবার স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে তৈরি করা হয়েছে কি না। ভেজাল তেল, বেসন ও কৃত্রিম রং মেশানো হয়েছে কি না, সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। যে তেলে ভাজা হয়, সেই তেল একবারের বেশি ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ, একই তেল বারবার আগুনে ফোটানো হলে কয়েক ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য তৈরি হয়, যেমন– পলি নিউক্লিয়ার হাইড্রোকার্বন, যার মধ্যে বেনজা পাইরিন নামে ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে এমন পদার্থের মাত্রা বেশি থাকে।

তা ছাড়া অপরিষ্কারভাবে ইফতারি তৈরি করলে পেটের পীড়া হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সুস্থভাবে বাঁচার জন্য যত্রতত্র খোলা খাবার না খাওয়াই উচিত। খুব কম ফলই পাওয়া যাবে যা ভেজালমুক্ত। শরবতের কথা তো বলাই বাহুল্য। রাস্তাঘাটে, হাটবাজারে রকমারি শরবত তৈরি করা হয়। আমাদের জানতে হবে, এসব শরবত যে পানি দিয়ে বানানো হয়, সে পানি বিশুদ্ধ কি না। তা ছাড়া ইফতারের জন্য তৈরি প্রায় সব খাবার তেলও উচ্চ চর্বিযুক্ত। সাধারণত এসব খাবার মানসম্মত তেলে এবং সঠিক নিয়মে ভাজা হয় না। তাই এসব স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
একজন রোজাদার ইফতারে কী খাবেন তা নির্ভর করবে তার স্বাস্থ্যের অবস্থা ও বয়সের ওপর। পারতপক্ষে দোকানের তৈরি ইফতার ও সাহ্রীসামগ্রী না খাওয়াই ভালো। সুস্থ, স্বাস্থ্যবান রোজাদারের জন্য ইফতারে খেজুর বা খোরমা, ঘরের তৈরি বিশুদ্ধ শরবত, কচি শসা, পিঁয়াজু, বুট, মৌসুমি ফল থাকা ভালো। ফলমূল খেলে ভিটামিন ও মিনারেল পাওয়া যায়, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয় এবং সহজে তা হজম হয়। রুচি অনুযায়ী বাসার রান্না করা নুডলসও খেতে পারেন।

বেশি ভাজা-ভুনা, তেহারি, হালিম না খাওয়াই ভালো। কারণ এতে বদহজম হতে পারে। রুচি পরিবর্তনের জন্য দু-একটি জিলাপি খেতে পারেন। তা ছাড়া গ্রীষ্মকালীন রমজানে পরিমাণমতো বিশুদ্ধ পানি পান করা উচিত। এশা ও তারাবির নামাজের পর অভ্যাস অনুযায়ী পরিমাণমতো ভাত, মাছ অথবা মুরগির মাংস, ডাল ও সবজি খাবেন। ইফতারের পর থেকে সাহ্রী পর্যন্ত পর্যাপ্ত পানি ও পানিযুক্ত খাবার গ্রহণ করা উচিত।

রাতের খাবার
এ সময়ের খাবার হালকা হতে হবে। ভাত বা রুটির সঙ্গে মুরগি, মাছ, শাক-সবজি পরিমাণ মতো খাওয়া উচিত।

কী খাবেন সাহ্রীতে
রোজার প্রধান খাবারই হচ্ছে সাহ্রী। সারাদিন অনাহারে থেকে রোজা পালন করতে হয় সাহ্রী খেয়েই। সাহ্রীতে সুষম পুষ্টিকর খাবার না হলে রোজা রাখা কষ্টদায়ক হতে পারে। ইফতারের মতো খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলো সাহ্রীর খাবার, তবে খুব বেশি পরিমাণে না খাওয়াই ভালো। রমজানে স্বাভাবিক নিয়ম পরিবর্তন করে সুবহে সাদিকের আগে ঘুম থেকে উঠে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিতে হয়।

সকালের নাশতার পরিবর্তে খুব ভোরে সারাদিনের উপবাসের সময় চলার মতো খাবারের প্রয়োজন হয়। শরীরটাকে সুস্থ রাখার জন্য সাহ্রী খাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, সাহ্রীর খাবার মুখরোচক, সহজপাচ্য ও স্বাস্থ্যসম্মত হওয়া প্রয়োজন। অধিক তেল, অধিক ঝাল, অধিক চর্বিজাতীয় খাবার খাওয়া একদম উচিত নয়।
ভাতের সঙ্গে মিশ্র সবজি, মাছ অথবা মাংস খাবেন। অনেকেই মনে করেন, যেহেতু সারাদিন না খেয়ে থাকতে হবে, তাই সাহ্রীর সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত বেশি বেশি খাবার খেতে হবে। তা মোটেও ঠিক নয়। কারণ, চার-পাঁচ ঘণ্টা পার হলেই খাদ্যগুলো পাকস্থলি থেকে অন্ত্রে গিয়ে হজম হয়ে যায়। তাই প্রয়োজনের তুলনায় বেশি না খাওয়াই ভালো। বরং মাত্রাতিরিক্ত খেলে ক্ষতির শঙ্কাই বেশি।
পিপাসা নিবারণ হয়, সেই পরিমাণ পানি নিজের অভ্যাস অনুযায়ী পান করতে হবে। দীর্ঘ সময় অভুক্ত থাকার কারণে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। পানিশূন্যতার কারণে শরীরে নানা জটিলতা দেখা দেয়। তাই ইফতার থেকে সাহ্রী পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে অন্তত দেড় থেকে দুই লিটার পানি পান করবেন।

অনেকে পানির পরিবর্তে লেমন অথবা রোজ ওয়াটার, ফ্রুট ওয়াটার, নানা ধরনের শরবত, ভিটামিন ওয়াটারসহ নানা ধরনের প্রক্রিয়াজাত পানীয় পান করেন। এগুলো পরিহার করা ভালো। রোজাদারদের শুধু বিশুদ্ধ পানি পান করাই ভালো। প্রচুর সবুজ শাকসবজি, ফলমূল আহার করা উচিত।

উপসংহার
রমজান মাসে রোজা রাখার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সহজেই তার স্বাস্থ্যের উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটাতে পারেন, যদি ঠিক ডায়েট অনুসরণ করা হয়।

কিছু টিপস মনে রাখুন
(১) অতিভোজন থেকেও বিরত থাকুন। খাবার ভালোভাবে চিবিয়ে ধীরে ধীরে খান, যা আপনার হজমে সহায়ক হবে।
(২) কখনোই শুধু পানি খেয়ে রোজা রাখবেন না।  অনেকেই সাহ্রীতে কিছু না খেয়েই রোজা রাখেন, তা ঠিক নয়। সাহ্রী খাওয়াও সুন্নত।
(৩) ইফতার ও সাহ্রীর সময়ের মধ্যে অন্তত আট গ্লাস পানি পান করুন। গ্লাস গুনে পানি খেতে অসুবিধা হলে সমপরিমাণ পানি বোতলে ভরে রাখুন এবং ইফতার থেকে সাহ্রীর সময়ের মধ্যে তার পুরোটা পান করুন।
(৪) ইফতারে বেশি ক্যালরিসমৃদ্ধ এবং সহজে ও তাড়াতাড়ি হজম হয়, এমন খাদ্য গ্রহণ করুন। সাহ্রীতেও সহজপাচ্য খাবার খান।
(৫) ভাজাপোড়া ও অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাদ্য বুক জ্বালাপোড়া এবং বদহজমের সমস্যা তৈরি করে। তাই এগুলো বর্জন করুন।
(৬) রান্নার সময় ডালডার পরিবর্তে সয়াবিন তেল ব্যবহার করুন। তবে যতটা সম্ভব পরিমাণ কম করে ব্যবহার করুন।
(৭) অতিরিক্ত লবণ ও লবণাক্ত খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন। কারণ, এসব রোজার সময় পানির পিপাসা বৃদ্ধি করে।
(৮) যাদের চা, কফি, সিগারেট, মাদকদ্রব্য ইত্যাদি ব্যবহারের আসক্তি আছে, তারা এগুলো কমিয়ে আনার চেষ্টা করুন। হঠাৎ এগুলো ছেড়ে দিলে মাথাব্যথা, রাগ, মেজাজ খিটখিটে ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
(৯) ঘুমানোর আগে ও সাহ্রীর পরে অবশ্যই দাঁত ব্রাশ করতে ভুলবেন না।
(১০) রোজা রাখা অবস্থায় সকালে ব্যায়াম না করে ইফতারের পর ব্যায়াম করা উচিত।
(১১) দিনে গরমের সময়ে ঠা-া ও ছায়াযুক্ত স্থানে থাকা উচিত। সম্ভব হলে শারীরিক পরিশ্রম কম করুন।
মনে রাখবেন, অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের কারণেই অসুস্থতা দেখা দিয়ে থাকে। ১১ মাস পর এ সময়ে রোজাদারদের খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রায় হঠাৎ বেশ পরিবর্তন আসে। তাই যারা নিয়মিত রোজা রাখেন, তাদের খাদ্য গ্রহণ ও স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।
    লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক

×