ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৪ মার্চ ২০২৫, ২০ ফাল্গুন ১৪৩১

কৃষি ঋণ ও কৃষি ব্যাংক

শিব্বির আহমেদ তাশফিক

প্রকাশিত: ২০:৩৫, ৪ মার্চ ২০২৫

কৃষি ঋণ ও কৃষি ব্যাংক

কৃষি ঋণ ও কৃষি ব্যাংক

বাংলাদেশের অর্থনীতির মূলভিত্তি কৃষি। দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। খাদ্য উৎপাদন, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন এবং জাতীয় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য কৃষি খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তবে কৃষি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ, আধুনিক প্রযুক্তি এবং উন্নত চাষাবাদের ব্যবস্থা সবসময় কৃষকদের নিজস্ব সম্পদ দিয়ে সম্ভব হয় না। এ ঘাটতি পূরণ করতে কৃষিঋণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (ইকই) দেশের একমাত্র বিশেষায়িত ব্যাংক, যা সরাসরি কৃষি অর্থায়নের মাধ্যমে কৃষকদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ১৯৭৩ সালে স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত হয় কৃষি খাতকে শক্তিশালী করার জন্য। দেশীয় কৃষকদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া এবং কৃষির প্রসার ঘটানোর লক্ষ্যেই এ ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয়। অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের তুলনায় বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের প্রধান বিশেষত্ব হলো, এটি একমাত্র ব্যাংক, যা সরাসরি কৃষকদের ঋণ প্রদান করে থাকে।

দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ব্যাংকের শাখাগুলো বিস্তৃত থাকায় কৃষক সহজেই ঋণ সুবিধা পেতে পারেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ব্যাংকটি ফসল চাষ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ চাষ, পোল্ট্রি খাত, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এবং গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণ প্রদান করে আসছে। কৃষক ও গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে এ ব্যাংক দেশের কৃষি অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো, কৃষকদের স্বাবলম্বী করে তোলা, কৃষি উৎপাদন বাড়ানো এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
কৃষি ঋণ কৃষকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা। এটি মূলধনের অভাব দূর করে, কৃষির আধুনিকায়ন নিশ্চিত করে এবং কৃষকদের আয় বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক সরাসরি কৃষকদের জন্য ঋণ প্রদান করে, যা তাদের উন্নত কৃষি উপকরণ সংগ্রহ করতে সাহায্য করে। উন্নতমানের বীজ, সার, কীটনাশক এবং আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। যা কৃষকের আর্থিক সচ্ছলতা নিশ্চিত করে।

বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের দেওয়া ঋণের মাধ্যমে কৃষক তাদের ফসল উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন ফসল চাষ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে বিনিয়োগ এবং কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে পারছেন। বিশেষ করে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা হলে তারা তাদের কৃষি কার্যক্রম সম্প্রসারণ করতে পারেন এবং স্থানীয় বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেন।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের কৃষিঋণ কর্মসূচি পরিচালনা করছে, যা সরাসরি কৃষি খাতের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- ফসল ঋণ (ধান, গম, ভুট্টা, ডাল, আলু ও অন্যান্য মৌসুমি ফসল উৎপাদনের জন্য কৃষকদের স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া হয়); কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ঋণ (আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি যেমন- ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, হারভেস্টার, সেচযন্ত্র ইত্যাদি কেনার জন্য ঋণ প্রদান করা হয়); প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাতের ঋণ (গবাদিপশু পালন, হাঁস-মুরগির খামার স্থাপন এবং মাছ চাষের জন্য বিশেষ ঋণ দেওয়া হয়, যা দেশের আমিষের চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখে); ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষি উদ্যোক্তা ঋণ (গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষি ব্যবসার বিকাশে বিশেষ ঋণ সুবিধা প্রদান করা হয়); গ্রামীণ ক্ষুদ্রঋণ (প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকদের জন্য জামানতবিহীন ঋণের সুযোগ রয়েছে, যাতে তারা সহজেই ঋণ নিতে পারেন); সবুজ অর্থায়ন ঋণ (পরিবেশবান্ধব কৃষি কার্যক্রম, যেমন- জৈব কৃষি, সোলার প্যানেল সেচ ব্যবস্থা এবং পুনঃব্যবহারযোগ্য জ্বালানির জন্য ঋণ প্রদান করা হয়) ইত্যাদি। 
কৃষিঋণ বিতরণে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে, যা কৃষকদের ঋণপ্রাপ্তি এবং ঋণ ব্যবস্থাপনায় বাধা সৃষ্টি করে। অনেক প্রান্তিক কৃষক ব্যাংকিং প্রক্রিয়া সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন না। ফলে তারা সহজে ঋণের জন্য আবেদন করতে পারেন না। ভূমিহীন কৃষকদের জন্য ব্যাংকের ঋণপ্রাপ্তি কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, বেশিরভাগ ঋণই নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পত্তির ওপর ভিত্তি করে প্রদান করা হয়। অনেক সময় কৃষিঋণ অনুমোদনের প্রক্রিয়া দীর্ঘ হয়, যা কৃষকদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে।

অনেক কৃষক ঋণ নিতে চাইলেও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতে পারেন না। ফলে তারা ঋণের বাইরে থেকে যান। অন্যদিকে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বাজারের অস্থিরতা অনেক কৃষককে ঋণ পরিশোধে সমস্যায় ফেলে, যা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক যদি আরও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে, তবে ঋণ বিতরণের প্রক্রিয়া আরও সহজ করা সম্ভব হবে। ডিজিটাল ঋণ ব্যবস্থা চালু করলে কৃষকরা মোবাইল অ্যাপ বা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে ঋণের জন্য আবেদন করতে পারবেন এবং সহজে অনুমোদন পেতে পারেন। প্রান্তিক কৃষকদের জন্য জামানতবিহীন ঋণের পরিমাণ বাড়ানো দরকার, যাতে ক্ষুদ্র কৃষক সহজেই ঋণের সুযোগ পান।

ঋণের সুদের হার সহনীয় রাখা এবং বিশেষ করে দুর্যোগকবলিত কৃষকদের জন্য ঋণ মওকুফের সুবিধা চালু করা হলে কৃষকরা ঋণ নিতে আরও আগ্রহী হবেন। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের উচিত ঋণ পরিশোধ পদ্ধতি সহজ এবং কিস্তির সময়সীমা দীর্ঘ করা, যাতে কৃষক সহজে ঋণ পরিশোধ করতে পারেন। পাশাপাশি, মাঠপর্যায়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের আরও সক্রিয় হতে হবে, যাতে তারা সরাসরি কৃষকদের সহায়তা এবং ঋণের যথাযথ ব্যবহারের নিশ্চয়তা দিতে পারেন।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক দেশের কৃষি অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করে এটি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন এবং গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে আরও কার্যকর ঋণ ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তিনির্ভর ঋণ সুবিধা এবং প্রান্তিক কৃষকদের জন্য সহজে ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা উচিত। সঠিক নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক আরও কার্যকরভাবে কৃষকদের সহায়তা করতে পারবে, যা দেশের অর্থনীতির অগ্রগতিতে গগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কৃষি ঋণের প্রসার ঘটিয়ে, কৃষকদের আরও বেশি স্বাবলম্বী করা গেলে বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতি আরও শক্তিশালী ও টেকসই হয়ে উঠবে।

লেখক : এমএসসি, বুয়েট, 
শিক্ষক ও গবেষক

[email protected]

×