ঢাকা, বাংলাদেশের রাজধানী, এক ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক শহর। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এই শহরটি আজ বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এখানকার বায়ু দূষণের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে, যা শহরের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। শনিবার (১ মার্চ) শহরটির বাতাস ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ অবস্থায় রয়েছে। বিশ্বের ১২৪টি শহরের মধ্যে সকাল ১০টার দিকে বায়ুদূষণে রাজধানী ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। আন্তর্জাতিক বায়ুমান প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের তথ্যানুযায়ী, ১৭৪ স্কোর নিয়ে বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ঢাকা। এই দূষণের পেছনে অনেক কারণ জড়িত। ঢাকা শহরের রাস্তায় অসংখ্য যানবাহন চলাচল করে, যাদের বেশিরভাগই পুরনো ও নিম্নমানের। জ্বালানি ব্যবহারে এই যানবাহনগুলো থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ুকে দূষিত করে। একটা বাসের ‘ইকোনমিক লাইফ’ সাধারণত ১০-১৫ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। উন্নত দেশগুলোতে বাসের ইকোনমিক লাইফ শেষ হওয়ার পর সেগুলোকে সড়ক থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। কারণ কোনো যানবাহনের ইকোনমিক লাইফ শেষ হয়ে গেলে সেগুলো ঠিকভাবে জ্বালানি পোড়াতে পারে না। তখন সেগুলোর ধোঁয়ার সঙ্গে ক্ষতিকর রাসায়নিক নির্গত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে যানবাহনের ইকোনমিক লাইফ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও অবাধে চলাচল করতে পারে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ এবং ট্র্যাফিক পুলিশদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে।
দূষণবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ক্যাপস-এর ‘দেশব্যাপী ৬৪ জেলার বায়ুদূষণ সমীক্ষা ২০২১’ অনুযায়ী, ঢাকার আশপাশের প্রায় ১২০০ টি ইটভাটা, ছোট-বড় কয়েক হাজার শিল্প কারখানা আছে, যেগুলো দূষণের অন্যতম কারণ। বাংলাদেশের বেশিরভাগ ইটভাঁটি এখনো সনাতন পদ্ধতিতে চলছে। এইসব ইটভাঁটিতে জ্বালানি হিসেবে কয়লা, কাঠ ব্যবহার করা হয়। ফলে এটা থেকে প্রচুর ছাই তৈরি হয় এবং কার্বন মনোঅক্সাইড, সালফার অক্সাইড ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো দূষিত কণা বাতাসের সঙ্গে মেশে। শহরের আশপাশে অবস্থিত শিল্প কারখানাগুলো থেকে নির্গত ধোঁয়া ও রাসায়নিক পদার্থ বায়ুকে দূষিত করে। রাজধানীতে সারাবছরই ছোট-বড় অজস্র ভবন নির্মাণ এবং রাস্তা মেরামতের কাজ চলে। এর পাশাপাশি গত কয়েকবছরে যোগ হয়েছে মেট্রো-রেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বিভিন্ন বড় প্রকল্প। যেকোনো ধরনের নির্মাণ কাজ করার সময় বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে সেসব নিয়ম পালনের তোয়াক্কা করতে দেখা যায় না। চলমান নির্মাণ কাজ থেকে প্রচুর ধুলোবালি বাতাসে মেশে, যা বায়ু দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে শহরের বিভিন্ন স্থানে বর্জ্য জমে থাকে, যা পচে গিয়ে বায়ুকে দূষিত করে। বর্জ্য পোড়ানো বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। ক্যাপসের গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকার যেসব এলাকায় বর্জ্য পোড়ানো হয়, সেইসব এলাকাতেই বায়ুদূষণ বেশি হচ্ছে। ময়লার স্তূপ যেখানে থাকে, সেখানে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। অনেক সময় মিথেন গ্যাসের দুর্গন্ধ থেকে বাঁচার জন্য পরিচ্ছন্ন কর্মীরা আগুন জ্বালায়। আইনগতভাবে পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ হলেও এর কেউ তোয়াক্কা করে না। এমনকি পুলিশও এর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয় না। যার ফলে প্রতিনিয়ত মানুষের ধূমপান থেকে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।
বায়ু দূষণের প্রভাব জনজীবনের ওপর অত্যন্ত ভয়াবহ। বায়ু দূষণের ফলে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, হৃদরোগ, ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ধরনের মারাত্মক রোগ দেখা দিচ্ছে। বায়ু দূষণের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, যা জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বায়ু দূষণের কারণে মানুষের কর্মক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বায়ু দূষণ রোধে আমরা বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি। পুরনো ও নি¤œমানের যানবাহন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে। শিল্প কারখানাগুলো থেকে নির্গত ধোঁয়া ও রাসায়নিক পদার্থ নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। শিল্প কারখানার বর্জ্য পদার্থ নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে যাতে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করতে না পারে। নির্মাণ কাজ থেকে নির্গত ধুলোবালি নিয়ন্ত্রণে পানি ছিটানোর মতো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। ইটভাটাগুলো থেকে নির্গত ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে এবং ইটভাটার ধোঁয়া যতটুকু সম্ভব ওপরের দিকে ছাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে যাতে ময়লা আবর্জনা যত্রতত্র না ফেলে। প্রয়োজনে এর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও গ্রহণ করা যেতে পারে। বেশি বেশি করে গাছ লাগাতে হবে, যাতে বায়ু দূষণ রোধ করা যায়।
ঢাকা শহরের বায়ু দূষণ একটি জটিল সমস্যা, যার সমাধান সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সম্ভব। সরকারের পক্ষে কখনোই এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে না যদি না জনগণ সচেতন হয়। আমাদের সকলের উচিত সচেতন হওয়া এবং বায়ু দূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। চলুন আজ থেকেই আমরা শপথ নিই, ‘বায়ু দূষণ রোধ করি, একে অপরের জীবন রক্ষা করি।’
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ
