
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা টেকসই উন্নয়নের সবচেয়ে বড় শত্রæ। এটি কেবল একটি সমস্যা নয়, এটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে একটি অন্তর্ঘাত। যখন রাজনীতি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়, তখন উন্নয়নও পথ হারায়। রাষ্ট্রযন্ত্র বিপর্যস্ত হয়, প্রশাসন ভেঙে পরে, আর জাতীয় অগ্রগতি থমকে দাঁড়ায়। টেকসই উন্নয়ন কোনো ফাঁপা ¯েøাগান নয়, এটি একটি রাষ্ট্রের আত্মার সন্ধান। কিন্তু সেই আত্মা যদি রাজনৈতিক অস্থিরতার দাবানলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়, তবে উন্নয়নের শরীরে শুধু পোড়া দাগই থেকে যায়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা মূলত টেকসই উন্নয়নের শিরদাঁড়া। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন নীতি নয়, বরং অর্থনীতি, সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার গভীরে প্রোথিত এমন একটি কাঠামো, যার ওপর দাঁড়িয়ে একটি জাতির অগ্রগতি নির্ভর করে। বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা শুধু উন্নয়নের সহায়ক উপাদান নয়, এটি উন্নয়নের পূর্বশর্ত। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা উপেক্ষা করে উন্নয়নকে কল্পনা করা মানে মরুভ‚মিতে বীজ বপন করার মতো দৃষ্টিনন্দন স্বপ্ন দেখানো হলেও, বাস্তবতা একেবারেই শূন্য।
যে জাতির রাজনীতিতে ভারসাম্য নেই, সেখানে টেকসই উন্নয়ন কেবল কাগজে আঁকা নকশা, যার ভিত্তি অস্থিরতায় নিমজ্জিত। টেকসই উন্নয়ন মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সম্ভাবনা ও বর্তমানের অগ্রগতির মধ্যে এক সুষম ভারসাম্য, যেখানে অর্থনীতি, সমাজ এবং পরিবেশ একত্রে পথ চলে। কিন্তু এই তিনটি স্তম্ভ যদি রাজনৈতিক অস্থিরতার ভ‚মিকম্পে কেঁপে ওঠে, তবে সেই উন্নয়ন হয় অন্তঃসারশূন্য, বহিরঙ্গ সাজসজ্জা মাত্র। টেকসই উন্নয়ন কখনোই এককভাবে অর্থনীতি, সমাজ বা পরিবেশের উন্নয়ন নয়। বরং, এটি এমন একটি কাঠামো, যা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর দাঁড়িয়ে, সার্বিক উন্নতি সাধন করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই বাস্তবতা নির্মমভাবে প্রকাশ পায়। একদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অশান্তি, ক্ষমতার লড়াই এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা, অন্যদিকে উন্নয়নের প্রতিশ্রæতি। রাজনৈতিক অস্থিরতার আসল মূল্য যে কতটা গভীর, তা অর্থনীতির প্রেক্ষাপট দিয়ে আরও সহজে উপলব্ধি করা যায়। বাস্তবিক অর্থে রাজনৈতিক অস্থিরতা হলো অর্থনৈতিক স্থবিরতা। যখন ক্ষমতা নিয়ে নিজেদের ভিতরে অন্তর্দ্ব›দ্ব চলতে থাকে তখন ক্ষমতার টানাপোড়েন এবং অনিশ্চয়তার শেকলে শিল্পাঞ্চল স্তব্ধ হয়ে যায়। বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারায়। কেননা তারা জানে, এ অস্থিতিশীল দেশে বিনিয়োগ মানে অগ্নিকুÐে অর্থ ঢালা। মূলত রাজনৈতিক অস্থিরতা বৈদেশিক বাণিজ্যের শিরায় আঘাত হানে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ধূলিসাৎ হয়, ব্যবসায় আস্থার সংকট তৈরি হয়, কর্মসংস্থান কমে যায়, মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায় এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার মন্থর হয়। ফলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পরে।
শুধু অর্থনীতিতেই নয় শাসন ব্যবস্থায় অস্তিত্বসংকট ও প্রশাসনিক পঙ্গুত্ব দেখা দেয়। রাজনীতি যখন প্রশাসনের ওপর চেপে বসে, তখন প্রশাসনিক দক্ষতা পঙ্গু হয়ে যায়। দলীয়করণ প্রশাসনের স্বাধীনতাকে গলা টিপে ধরে। পুলিশ, বিচারব্যবস্থা এবং প্রশাসন সবই এক অদৃশ্য সুতোর টানে পরিচালিত হতে থাকে। ফলে আইন হয় পক্ষপাতদুষ্ট, বিচার হয় রাজনৈতিক হাতিয়ার, আর শাসনব্যবস্থা হয়ে দাঁড়ায় অনুগত্যের প্রতীক। এ অবস্থা সমাজ ও রাষ্ট্রে ভয়াবহ অসমতা, নির্বিচার ও অন্যায়ের দিককে নির্দেশ করে। সবচেয়ে বড় বিষয় সামাজিক বিভাজন এবং মূল্যবোধের সংকট ও উন্নয়নের দ্ব›দ্ব দেখা দেয়। কেননা টেকসই উন্নয়ন কেবল অর্থনৈতিক সূচকের গল্প নয়; এটি ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা ও প্রজন্মান্তরে দায়বদ্ধতার সমন্বয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এ মূল্যবোধকে কর্পোরেট স্বার্থ বা গোষ্ঠীগত এজেন্ডার কাছে বন্ধক দেয়। ফলে প্রকৃত উন্নয়নের পরিবর্তে ‘উন্নয়নের মিথ’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রকল্পের নামে সম্পদ পাচার বা পরিবেশ বিনাশ বৈধতা পায়। শুধু তাই নয় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সমাজের ভিতরে বৈষম্য সৃষ্টি করে। নাগরিককে-নাগরিকে আস্থার সংকট তৈরি হয়। স্বাভাবিকভাবেই নাগরিক ও রাষ্ট্র সম্পর্কের ভিত্তি যখন অনিশ্চয়তায় পর্যবসিত হয়, তখন সমষ্টিগত উদ্যোগ ভেঙে পড়ে। এ অবস্থা চলতে থাকলে রাষ্ট্র ধ্বংসের অন্ধকার গহব্বরে নিমজ্জিত হবে। তাই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কাঠামো অপরিহার্য। এক্ষেত্রে রাজনীতি যেন জনগণের স্বার্থে পরিচালিত হয়, এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও একটি জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হলেও এই পরিকল্পনার ধারাবাহিকতা যেন বজায় থাকে সে দিকটি লক্ষ্য রাখতে হবে। নীতিনির্ভর প্রশাসন গঠনে কাজ করতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো দলীয় স্বার্থের বাইরে রেখে স্বাধীন প্রশাসনিক কাঠামোর অধীনে পরিচালিত করতে হবে। রাজনৈতিক পালা বদলের সময়ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ যেন অটুট থাকে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে মুক্ত থাকতে এবং রাষ্ট্রের মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্ক তৈরির জন্য স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। গবেষণামূলক পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোতে গবেষণাভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা দরকার। এতে উন্নয়নে দ্রæত গতি প্রাপ্ত হবে। সর্বোপরি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা টেকসই উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এটি শুধু সহিংসতা নয়, এটি রাষ্ট্রের আত্মাকে ক্ষতবিক্ষত করার একটি প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের রাজনীতি এবং উন্নয়নমূলক প্রক্রিয়া একটি বুনন, যেখানে একে অপরের সঙ্গে মিলিত হয়ে একটি নতুন দিশারী গড়ে তুলতে পারে। এ দেশটির জন্য উন্নয়ন যেন শুধু প্রতিশ্রæতিতেই আবদ্ধ না থেকে উন্নয়ন এবং অগ্রগতির ধারা যেন দৃশ্যমান সাফল্যে রূপান্তরিত হয়। একমাত্র শক্তিশালী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি একসঙ্গে মিলিত হলে, তা বাংলাদেশের প্রকৃত সমৃদ্ধির মূল চাবিকাঠি হবে। কেননা উন্নয়ন তখনই টেকসই হয়, যখন রাজনীতি তার দায়িত্বশীল অবস্থান গ্রহণ করে প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে রাষ্ট্রের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া উন্নয়ন শুধু মরীচিকা, একটি শূন্য প্রতিশ্রæতি। তাই দেশ ও জাতির স্বার্থে প্রতিপক্ষের ধ্বংসে নয়, রাষ্ট্রের নির্মাণে মনোনিবেশ করা উচিত। প্রতিহিংসার গÐি ভেঙে, টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়াই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। কারণ টেকসই উন্নয়ন কোনো দলের নয়, এটি পুরো জাতি এবং রাষ্ট্র স্বার্থের প্রশ্ন।
শিক্ষার্থী, ইডেন মহিলা কলেজ