
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানী তার বয়ানে বাঙালি জনপদকে বুলগাকপুর বা বিদ্রোহের নগরী বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। জিনগতভাবে বিদ্রোহ কেন্দ্রিক মনোভাবের ফলে সম্রাট আকবরের মতো শাসকও বাঙালির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। সভ্যতার বিবর্তন, এমনকি ১৯০৫ সালে ইংরেজদের বিভাজন নীতি প্রয়োগের পরেও বাঙালি জাতীয়তাবাদের অস্তিত্ব ভালোভাবেই টিকে ছিল। তবে ধর্মীয় সংঘাত, শ্রেণি বিভাজন, রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবে বাঙালি জাতির ভাঙন এড়ানো সম্ভব হয়নি। ধর্মীয় বাস্তবতায় মোহাম্মদ আলী জিন্নার দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ দ্বিখণ্ডিত হয় ভারত ও পাকিস্তান নামে। তবে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ মাত্র চব্বিশ বছরের ব্যবধানেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের চেতনায় এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বাংলাদেশের ৫৩ বছরের রাজনৈতিক পরিক্রমা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হওয়ার পরেও ১৯৭৫, ১৯৮২, ১৯৯০, ২০০৭, ২০১৩, ২০১৮ এবং সর্বশেষ ২০২৪ এ রক্তের হোলিখেলার চরম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে যেতে হয়েছে। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, প্রতিবারই বাঙালি জাতিসত্তার সেই বিদ্রোহের ভাবমূর্তি মগজে জমে উঠেছে এবং রক্ত দিয়ে হোলি খেলার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। এসব ঘটনায় শাসকের যেমন দায় রয়েছে, তেমনি রক্ত গরম প্রজাদের প্রশ্নবিদ্ধ নৈতিকতা ও মনোজগতের সংঘাতকেও অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। তাই, আশার বাণী শুনতে শুনতে বাংলাদেশের ৫৩ বছর কাটিয়ে দেওয়া এই জাতিকে ২০২৫ এ এসে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সন্ধানে এগোতে হচ্ছে। তবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের মগজ ধোলাই হওয়ার সহজাত চিত্রকে উপেক্ষা করে কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার বাস্তবতা কতটুকু রয়েছে, ৫ আগস্ট, ২০২৪ পরবর্তী সহিংসতা দেখা দেওয়ায় তা নিয়ে স্বভাবতই দেখা দিয়েছে সংশয়।
জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলার ছাত্রসমাজ বাংলাদেশপন্থি চিন্তাধারার একটি নব চেতনার জন্ম দিয়েছে এবং নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে জাতির সামনে দাঁড়িয়েছে। ভারতপন্থি, পাকিস্তানপন্থি, আমেরিকাপন্থি, রাশিয়াপন্থি বা চায়নাপন্থি বলয় থেকে বের হয়ে বাংলাদেশের নিজস্ব জাতিসত্তা; বাংলাদেশপন্থি হয়ে মাথা উঁচু করার স্পৃহা তৈরি হয়েছে। গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বাংলাদেশপন্থি স্লোগানের ওপর মানুষের একটি আস্থা ও বিশ্বাসের জন্ম হয়েছে। তবে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাঝে বাংলাদেশপন্থি চিন্তাধারাকে প্রতিপালনের কতটুকু সদিচ্ছা রয়েছে!
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মাঝে ডিপ স্টেট ছায়া রাষ্ট্রের প্রেসক্রিপশনে নির্বাচন অনুষ্ঠান ও ক্ষমতার হস্তান্তরের অহরহ উদাহরণ লক্ষ্য করা যায়, যা রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের জনগণের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। বাংলাদেশে ছায়া রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ প্রভাব না থাকলেও পরোক্ষভাবে বিভিন্ন ঘটনায় তাদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে বিভিন্ন সময় জনগণের মাঝে সন্দেহ ও উদ্বেগ দেখা গেছে। ফলে ২৪ পরবর্তী সময়ে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছায়া রাষ্ট্রের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে কতটুকু সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারবেন, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ঐতিহ্যগতভাবে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামের সফলতা পরবর্তী কিছু রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ হয়। তবে ’২৪ পরবর্তী প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। বিগত সময়ে প্রবীণ বা সামরিক ব্যক্তিবর্গের নেতৃত্বে রাজনৈতিক শক্তির উত্থান হলেও এবার অপেক্ষাকৃত তরুণ ও ছাত্র নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান হতে যাচ্ছে। যেখানে তথাকথিত কিংস পার্টির সম্ভাবনা কেউ উড়িয়ে দিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসছেন ’২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের নায়ক অন্তর্বর্তী সরকারের সদ্য সাবেক তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর সভা থেকে পদত্যাগ করে তিনি বিরল দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন, যা বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি নতুন সংযোজন হিসেবেই সমাদৃত হবে।
সম্প্রতি, বৃহত্তর রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতৃবৃন্দ ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ’ নামে ছাত্রদের জন্য একটি নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছে। কিন্তু এই ছাত্র সংগঠনটির যাত্রা শুরু হলো একটি সংঘাতের ঘটনার মধ্য দিয়ে। নতুন প্রজন্মের পূর্বপুরুষদের চিরাচরিত মারমুখী রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ঊর্ধ্বে গিয়ে মনোজগতে যে নব উদ্যম ও স্বপ্নের সঞ্চার হয়েছিল, সম্প্রতি বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং সর্বশেষ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সংঘাতে জড়ানোর ঘটনা সেই স্বপ্নকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এমনকি সময়ের পরিক্রমায় ছাত্রজনতার দেখা নতুন বাংলাদেশের বাংলাদেশপন্থি স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত স্বপ্নই থেকে যেতে পারে। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের আত্মপ্রকাশের শুরুতেই ক্ষমতার অংশীদারিত্ব নিয়ে ঘটে যাওয়া এ ধরনের সংঘাত জনগণের আকাক্সক্ষায় ইতোমধ্যে চিড় ধরিয়েছে। জনগণের ছাত্র নেতৃত্বের ওপর যে আস্থা সৃষ্টি হয়েছিল, সে আস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছে।
একদিকে যেমন ছায়া রাষ্ট্রের বিস্তার, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র, সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলার লক্ষণীয় অবনতি, বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষ থেকে নির্বাচনের চাপ, বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক নিম্নমুখিতার বাস্তবতায় নতুন দল নিজেদের কতটুকু প্রসারিত ও কার্যকর করতে পারবে, সে বিচার এই মুহূর্তে না করা গেলেও অনেক প্রশ্ন জনমনে তৈরি হয়েছে। ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সেই পুরনো মন সংঘাত তত্ত্বের বহির্প্রকাশ যে ঘটবে না, সেটিও জোর করে বলা যায় না।
যাই হোক, তাত্ত্বিক কথা হলো, যে দেশের নাগরিক যেমন হবে, সে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বও তেমন হয়! হতাশার পাল্লা সময়ের সঙ্গে বৃদ্ধি পেতে থাকলেও প্রত্যাশার পারদ বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ এখনো রয়েছে। বিভিন্ন অনলাইন জরিপ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, এমনকি চায়ের দোকানের রাজনৈতিক আলাপেও নতুন রাজনৈতিক শক্তির ওপর একটি প্রজন্মের প্রত্যাশা লক্ষ্য করা যায়। তারা বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশপন্থি চেতনা নিয়ে নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান হবে এবং সাম্য মর্যাদাসম্পন্ন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াসে তারা এগিয়ে যাবেন। কিন্তু তারা যদি জাতির প্রত্যাশা মেটাতে ব্যর্থ হন, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আবারও একটি সংকট দেখা দিতে পারে। তবে তাত্ত্বিক জায়গা থেকে দেখলে, জনগণ যদি সততার সঙ্গে নেতা নির্বাচন করে, তাহলে আপনি স্বপ্ন দেখতেই পারেন। আর যদি ভোটের রাতে পকেট ভর্তি করে নেতা নির্বাচন করেন, তাহলে এরকম ’২৪ বারবার বাংলায় নেমে আসবে। অর্থাৎ অযথা শাসককে দায় দিয়ে লাভ নেই। সিদ্ধান্ত আপনি, আমি তথা জনগণকেই নিতে হবে শেষ পর্যন্ত।
লেখক : প্রভাষক, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি