ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৩ মার্চ ২০২৫, ১৯ ফাল্গুন ১৪৩১

ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ

ভাষার অধিকার থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম

ড. আলা উদ্দিন

প্রকাশিত: ২০:২০, ২ মার্চ ২০২৫

ভাষার অধিকার থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ ছিল দীর্ঘ ও বেদনাময়, যা দেশভাগ-পরবর্তী কয়েক দশকের সংগ্রামের সাক্ষী। এই দীর্ঘ যাত্রায় ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাস বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। কারণ, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সময়ের ঘটনাগুলো জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের জন্য চালিত আন্দোলনই পরবর্তীতে স্বায়ত্তশাসন এবং এরই ধারাবাহিকতায় পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার সংগ্রামে রূপ নেয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসে তাই এই দুই মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। যদিও তা দীর্ঘ সময়ান্তরে সংঘটিত, তবে পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়, বরং চেতনা ও বাস্তবতায় কালোত্তীর্ণ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের শেকড় ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরপরই প্রোথিত হয়, যখন পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অংশ হয়ে পূর্ব পাকিস্তান নামে আত্মপ্রকাশ করে এবং নতুনভাবে স্পষ্ট হওয়া বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে সৃষ্টি হয় প্রতিক্রিয়া। শুরু থেকেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের ফলে অসন্তোষ ও উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান সংকট ছিল উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রচেষ্টা, যদিও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মাতৃভাষা ছিল বাংলা।
উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শুরু হয় ১৯৪৮ সালে, যার নেতৃত্ব দেন শিক্ষার্থী, বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক কর্মীরা। তাঁদের দাবি ছিল স্পষ্ট, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে হবে। বছরকে বছর এই আন্দোলন তীব্রতর হতে থাকে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে, যখন ঢাকায় প্রতিবাদরত ছাত্রদের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। এতে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ অনেকে শহীদ হন। তাঁদের এই আত্মত্যাগ ২১ ফেব্রুয়ারিকে প্রতিরোধ ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীকে পরিণত করে।
১৯৫২ সালের এই ভাষা আন্দোলন কেবল ভাষার অধিকারের লড়াই ছিল না, এটি ছিল কার্যত পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের মানুষের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বহুমুখী বৈষম্যের বিরুদ্ধে সামগ্রিক প্রতিবাদের বহির্প্রকাশ। এই সংগ্রামে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৫৬ সালে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায় বাংলা। তবে ততদিনে এই আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে বৃহত্তর জাতীয়তাবোধের জন্ম দিয়েছিল, যা ভবিষ্যতে স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়।  ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হয়। ১৯৯৯ সাল থেকে দিবসটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও বিশ্বব্যাপী পালিত হয়, যা ভাষা আন্দোলনের চিরস্থায়ী প্রভাব ও বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যদিও ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তি গড়ে দেয়, পরবর্তী কয়েক দশকে স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনির্ধারণের সংগ্রাম আরও তীব্র হয়ে ওঠে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ক্রমশ বিভাজনকে গভীরতর করে তোলে। নানা ঘাত-প্রতিঘাত, আন্দোলন ও দমন-পীড়নের পরিক্রমায় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ক্রমশ অধিকতর সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়ে সংগ্রামে। অবশেষে ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে স্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি অনিবার্য হয়ে ওঠে।
ডিসেম্বর ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে, জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন লাভ করে। এর ফলে ৩০০ আসনের জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, যা শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের বৈধ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তবে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী, বিশেষ করে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন শাসকশ্রেণি ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়। এর ফলে রাজনৈতিক সংকট চরমে পৌঁছে যায় এবং দেশ এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়।
যখন উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছিল, তখন ৭ মার্চ ১৯৭১ স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় হয়ে ওঠে। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখো মানুষের উপস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমান এক ঐতিহাসিক ভাষণ দান করেন, যা সমগ্র জাতিকে আন্দোলিত ও উদ্দীপ্ত করে। যদিও তিনি সেদিন সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি, তাঁর ভাষণের প্রতিটি শব্দ ভবিষ্যতের পথ স্পষ্ট করে দিয়েছিল-  ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম! এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম!’ এই ভাষণ বাঙালির হৃদয়ে গভীরভাবে প্রতিধ্বনিত হয়, লাখো মানুষকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করে তোলে এবং কার্যত পাকিস্তানি শাসনের প্রতি সর্বাত্মক অস্বীকৃতির সূচনা করে।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর ২৫ মার্চ ১৯৭১ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে এক নৃশংস সামরিক অভিযান চালায়। এই গণহত্যামূলক অভিযানে সেনারা ঢাকা শহরে নির্বিচারে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ, ছাত্র, শিক্ষক ও রাজনৈতিক কর্মীকে হত্যা করে।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যা বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধের অন্যতম কেন্দ্রস্থল ছিল, পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। ছাত্রাবাস, শিক্ষক কোয়ার্টারসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে চালানো হয় নির্মম হত্যাযজ্ঞ। এ রাতে অসংখ্য নিরীহ মানুষ শহীদ হন, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ ও অন্ধকারতম অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
২৫ মার্চের এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ যুদ্ধের অপরিহার্যতাকে স্পষ্ট করে তোলে। রক্তক্ষয়ী ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চের প্রারম্ভিক সময়ে গ্রেপ্তারের আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের নিকট প্রেরণ করেন। ২৬ তারিখেই চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এবং প্রায় একই সময়ে সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার উক্ত ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এই ঘোষণা সঙ্গে সঙ্গে সামরিক ও বেসামরিক-সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে গভীর উদ্দীপনা সৃষ্টি করে এবং মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটে।
স্বাধীনতা ঘোষণার পর পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ প্রতিরোধে দুর্বার হয়ে ওঠে। মুক্তিবাহিনী সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থনে সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে। নয় মাসব্যাপী এই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ঘটে ভয়াবহ যুদ্ধাপরাধ, যার মধ্যে ছিল গণহত্যা, ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন এবং লাখ লাখ মানুষের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপ যুদ্ধের গতিপথ বদলে দেয়। সাড়ে আট মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এর মধ্য দিয়ে চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। পূর্ব পাকিস্তানের নিপীড়িত ও সংগ্রামী মানুষ অর্জন করে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড ও লাল-সবুজের পতাকা-বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে অপরিসীম ত্যাগ ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে- প্রায় ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে, এক কোটি শরণার্থীর বাস্তুচ্যুত জীবনে, দুই লক্ষাধিক নারীর নিদারুণ নির্যাতন এবং অগণিত মানুষের যুদ্ধের ভয়াবহতায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে। তবে প্রকৃত স্বাধীনতা কেবল রাজনৈতিক মুক্তিতেই সীমাবদ্ধ নয়। যে স্বপ্ন মুক্তিযুদ্ধকে প্রেরণা জুগিয়েছিল তা শুধু একটি স্বাধীন ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠার জন্য ছিল না, বরং অন্যতম লক্ষ্য ছিল একটি ন্যায়সংগত, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিক্ষার প্রসার এবং অবকাঠামোগত উন্নতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক বৈষম্য এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো চ্যালেঞ্জ এখনো মুক্তির চেতনার পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের পথে বাধা।  
ফেব্রুয়ারি এবং মার্চের মতো ঐতিহাসিক সময় স্মরণ করার সময়। আমাদের আত্মবিশ্লেষণ করা জরুরি- আমরা কি সত্যিই সেই সকল মানুষের আকাক্সক্ষা এবং আত্মত্যাগকে যথাযথভাবে সম্মান জানিয়েছি, যারা এই জাতির জন্য ১৯৫২ থেকে লড়াই করেছেন? এখন সময় এসেছে গণতন্ত্র, ন্যায় এবং সমতার আদর্শগুলোকে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের পথনির্দেশক হতে হবে। ২১ ফেব্রুয়ারি এবং ২৬ মার্চের চেতনা শুধু ইতিহাসের পাতায় সীমাবদ্ধ না হয়ে সত্যিকারের স্বাধীনতার পূর্ণ সিদ্ধির জন্য একটি অবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টাকে অনুপ্রাণিত করতে হবে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের সময়কাল বাংলাদেশের ইতিহাস গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও স্বাধীনতার ইতিহাসে এই দুটি মাস ভাষার মাস ও অগ্নিঝরা মার্চ-  জাতির সার্বভৌমত্ব ও পরিচয়ের জন্য আন্দোলন, সংগ্রাম এবং ত্যাগের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে অবিস্মরণীয়। যদিও যুদ্ধের ময়দানে স্বাধীনতা অর্জন হয়েছিল, তবু চলমান সংগ্রাম সেই স্বপ্নগুলোর বাস্তবায়নেই নিহিত- যে স্বপ্নগুলো ১৯৬০-এর দশক থেকে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনকে প্রভূতভাবে প্রেরণা দিয়েছে। একটি ন্যায়, সমতা এবং সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ জাতি গড়ে তোলার জন্য আজও সেই সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে। শোষণমুক্ত বাংলাদেশের যাত্রা এখনো শেষ হয়নি। যখন আমরা অতীতকে স্মারণ ও সম্মান জানাই তখন আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে, যাতে এই বদ্বীপে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড এবং সাম্যের যে স্বপ্ন দেখা হয়েছিল তা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন হয়।

লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

×