
বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশে অন্যতম। জনসংখ্যার তুলনায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের সুবিধা অপ্রতুল। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার করলেও রাষ্ট্র দেশবাসীকে সুচিকিৎসার নিশ্চিত করতে পারেনি। অগণিত রোগীর বেসামাল অবস্থায় সরকারী হাসপাতালগুলো বিপর্যস্ত। দেশে রোগীর বিপরীতে ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য লোকবল, ওষুধপত্র, চিকিৎসা সরঞ্জাম ইত্যাদির সংকটে পর্যাপ্ত সেবাপ্রদান প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সক্ষমতার তুলনায় তিন-চারগুণ বেশি রোগীকে সেবাদান সর্বত্রই কঠিন রূপ পরিগ্রহ করেছে। স্বাস্থ্য খাতের করুন অবস্থা অবলোকন করতে দেশের বড় দুটি সরকারি হাসপাতাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভঙ্গুর অবস্থার দিকে তাকালে দেশের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে আঁচ করা যায়।
এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল রমরমা ব্যবসা করে যাচ্ছে। অধিকাংশের নেই অভিজ্ঞ ডাক্তার, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং লোকবল। প্রায় সময় দেখা যায় চিকিৎসার নামে টেস্ট বাণিজ্য, ভুল চিকিৎসায় রোগী মারা যাওয়া ও অপ্রীতিকর ঘটনা। দেশের বড় শহরগুলোতে বহুতল ভবনের হাসপাতালে মধ্যবিত্ত, নি¤œবিত্তের চিকিৎসা এক প্রকার অসম্ভব। অধিকাংশ পরিষেবায় অভিজ্ঞ-প্রশিক্ষিত কতিপয় চিকিৎসকের আকাশছোঁয়া ফি পরিশোধে জনগণের নাভিশ্বাস উঠছে। অসাধু এবং অবৈধ উপায়ে টাকা উপার্জনকারী ছাড়া মধ্যবিত্ত এবং নি¤œবিত্তের পক্ষে এ ব্যয় দুঃস্বপ্ন। তাছাড়া বিত্তশালী ব্যক্তি এবং প্রথম সারির রাজনীতিকরা ঘনঘন বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়া বিলাসিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা পরোক্ষভাবে গরিবের সঙ্গে ভেংচি কাটার সমান। চিকিৎসাসেবা সাধারণ মানুষের নাগাল থেকে কত দূর তা ২০২৪ সালের প্রথম দিকের একটি রিপোর্ট থেকে অনুমান করা যায়। রিপোর্টে দেখানো হয় দেশে সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালের সর্বমোট শয্যাসংখ্যা ১ লাখ ৭১ হাজর ৬৭৫টি। তাহলে প্রতি ৯৯০ মানুষের জন্য হাসপাতালে (সরকারি ও বেসরকারি) একটি শয্যাসংখ্যা ১টি। আর সরকারি হাসপাতালে ৫০ জন মানুষের বিপরীতে শয্যাসংখ্যা শূন্য দশমিক ২১১। দেশের বেহাল স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর থেকে চিকিৎসা ব্যয় বেশির দরুন বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
গত বছর ১৬ ফেব্রæয়ারি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সরকারি-বেসরকারি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে বাংলাদেশ থেকে বছরে সাড়ে তিন লাখ মানুষ চিকিৎসা নিতে দেশের বাইরে গিয়েছিল। এতে তাদের ব্যয় হয়েছিল ২০৪ কোটি ডলার। আর এখন যাচ্ছে বছরে প্রায় ২৭ লাখ ১০ হাজার রোগী। এ হিসাবে ব্যয় বেড়েছে ৪৫০ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে শুধু ভারতেই ব্যয় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা এবং দেশটিতে যাচ্ছে বিদেশে যাওয়া মোট রোগীর প্রায় ৯২ শতাংশ। গবেষণায় দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার আটটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো বিদেশে অভিজ্ঞ চিকিৎসক, কম চিকিৎসা ব্যয়, সঠিক রোগ নির্ণয় ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চিকিৎসা চলাকালে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা, মানসম্মত চিকিৎসা, রোগীদের জন্য চিকিৎসকদের পর্যাপ্ত সময় ব্যয়, চিকিৎসা পেতে কম সময় অপেক্ষা এবং সার্বিক স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান। স¤প্রতি ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক টানাপোড়েনের কারণে মোদি সরকার ভিসা বন্ধ করে দিলে মানুষ বিপাকে পড়ে।
এখন প্রশ্ন হলো চিকিৎসার জন্য দেশ থেকে মোটা অঙ্কের একটি টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। তাহলে রাষ্ট্র কেন জনগণের মৌলিক অধিকার চিকিৎসায় জোর দিচ্ছে না। যে টাকা চিকিৎসা জন্য বাইরে খরচ হচ্ছে ওই টাকা দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নয়নে ব্যয় করলে একদিকে যেমন চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি হতো তেমনিভাবে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হতো। এতে দুক‚লই রক্ষা করা যায়। বাজেট বরাদ্দের সময় দেখা যায় স্বাস্থ্য খাতে তুলনামূলক কম এবং যা দেওয়া হয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার থেকে ক্ষমতাসীন দলের লোকের পকেটে ঢুকে যায়। স্বৈরাচারের সময় করোনা মহামারির সময়ও স্বাস্থ্য খাত দুর্নীতি থেকে মুক্ত থাকেনি। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি দেখায় স্বাস্থ্য খাতে ১৮০০ চাকরির নিয়োগ নিয়ে কোটি টাকার ঘুষের প্রস্তাব, স্বাস্থ্যের সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকার কেনাকাটায় অনিয়ম হয়েছে।
আশার কথা হচ্ছেÑ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশের বিভিন্ন খাতে সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। গঠন করা হয়েছে স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশনসহ বিভিন্ন সংস্কার কমিশন। স্বাস্থ্য খাতের চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক স¤প্রতি ১২ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। দেশের মানুষ বিশ্বাস করে, গণঅভ্যুত্থানের জন্ম নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সংস্কার করবে। দেশেই সকল ধরনের আধুনিক চিকিৎসা পাবে। সর্বস্তরের মানুষের জন্য উন্নত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ