বিভিন্ন পত্রিকা সূত্র- প্রতিবেদনে ‘নারী বিষয়ক সংস্কার’ এর সুপারিশ, রূপরেখা এবং সংস্কার বর্তমান অগ্রগতি-অবস্থানসহ বিস্তারিত প্রকাশ পেয়েছে। সংস্কার কমিশনের প্রধান ও নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন পারভীন হক বলেন, ১. সংবিধান ও আইন, ০২. নীতিনির্ধারণ এবং ০৩. কর্মপরিকল্পনাÑএই তিনভাগে ভাগ করে সংস্কার প্রতিবেদন তৈরি হচ্ছে।
সংস্কার কমিশন যে প্রাথমিক অগ্রগতি ও সুনির্দিষ্ট রূপরেখা প্রকাশ করেছেন, তা খুবই গঠনমূলক, ধারাবাহিক, যুগোপযোগী এবং অবশ্যই বাস্তবায়নযোগ্য। এ পরিপ্রেক্ষিতে কমিশনের তিনভাগে ভাগ করা যৌক্তিক ও চিহ্নিত। তন্মধ্যে কমিশনের সম্মানিত সদস্য এবং সংশ্লিষ্ট যারা দেশের নারী বিষয় নিয়ে কাজ করছি, সকলের ধ্যন-ধারণা নিয়েই তিন নম্বরের কর্মপরিকল্পনা বিষয়ে আমাদের প্রস্তাবনা। কর্মপরিকল্পনার প্রতিপাদ্য হলোÑ
ক) মা নারী মেয়ে মহিলা-মানুষ।
খ) সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত মা’ই সকল বিষয়ের কেন্দ্রবিন্দু, ক্ষমতায়ন-তলরেখা।
গ) মা’র গর্ভাশয় থেকেই উন্নয়ন-অধিকার স্থাপন করতে হবে।
এ প্রেক্ষিতে-সরকারের কোষাগার থেকে গরিব মাদের ০৭ শর্তযুক্তে মাতৃকালীন ভাতা প্রদান করা যেতে পারে। একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরিকে ভিত্তি ধরে ভাতার পরিমাণ মাস প্রতি ৮ (আট) হাজার টাকা করা।
ভাতা প্রদান ৫ বছর মেয়াদি হবে। যাতে সন্তান স্কুলে যায় না, ঝরে পড়া এসব কথা থাকবে না। ৫ বছর মেয়াদ শেষ হলে মা-সন্তান কেন্দ্রিক স্বপ্ন প্যাকেজ ধার্য করতে হবে।
ঝড়পরধষ অংংরংঃধহপব চৎড়মৎধস ভড়ৎ ঘড়হ অংংবঃবৎং-ঝঅচঘঅ প্যাকেজ হলোÑ ৫ ভিত্তি সম্বলিত: ১. স্বাস্থ্য পুষ্টি ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্ড ২. শিক্ষা ও বিনোদন কার্ড ৩. স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন, পানিসহ একটি আবাসন ৪. জীবিকায়ন - কর্মসংস্থান সরঞ্জাম এবং ৫. সঞ্চয় ও পরিবেশ প্লাস।
স্বপ্ন প্যাকেজ মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান শুরু থেকে ২০ (৫+১৫) বছর অর্থাৎ এক প্রজন্ম মেয়াদি হবে। ২০ বছর এক প্রজন্ম মেয়াদে এক কোটি মা’কে টার্গেট করেতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন’ পেনশন স্কিম (১৮-৫০ বছর) আওতায় মাতৃত্বকালীন ভাতাপ্রাপ্ত মা’দের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা।
উপরোক্ত বর্ণিত মোটা দাগে সাতটি কর্ম পরিকল্পনা থাকবে। অভিজ্ঞ ও বাস্তবায়নকৃত সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় জাতীয়ভাবে নির্দিষ্ট নীতিমালা অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করবে। জাতীয়ভাবে প্রধান উপদেষ্টা/প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে এসডিজি মুখ্য সমন্বয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সাচিবিক দায়িত্বে ‘জাতীয় দারিদ্র্য বিমোচন কর্তৃপক্ষ’ গঠিত হবে কর্মপরিকল্পনা মনিটরিং করবে। এই কর্ম পরিকল্পনার আওতার বিস্তারিত নীতিমালা কাঠামো থাকবে। তন্মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্যÑ
ক) মা নির্বাচনে শর্ত ও গুণগতমান রক্ষা করার লক্ষ্যে মায়ের সংখ্যা বছরে ৫-৬ লাখের মধ্যে সীমাবন্ধ রাখা। কেননা, দেখা যায় প্রতি ইউনিয়নে গড়ে ৭০ জনের ঊর্ধ্বে মা গর্ভবতী থাকে না।
অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণমূলক বাস্তবায়ন কার্যার্থে পাবলিক (স্থানীয় সরকার) পুওর (মা) প্রাইভেট (বে-সরকারি সংস্থা) পার্টনারশিপ (পিপিপিপি) থাকবে।
খ) ৭টি শর্তযুক্ত মাতৃত্বকালীন ভাতা সরকারিভাবে বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করে চালু থাকবে। শর্তগুলো হলোÑ
প্রথম বা দ্বিতীয় গর্ভধারণকাল (যে কোনো একবার)
বয়স কমপক্ষে ২০ বছর বা ঊর্ধ্বে
মোট মাসিক আয়Ñ৩০০০/- টাকার নিচে। দরিদ্র্য প্রতিবন্ধী মা অগ্রাধিকার পাবেন
যৌথ বসতবাড়ি রয়েছে বা অন্যের জায়গায় বাস করে।
নিজের বা পরিবারের কোনো কৃষি জমি, মৎস্য চাষের জন্য পুকুর নেই।
মা নির্বাচনের সময় জুলাই মাসে মাকে গর্ভবতী থাকতে হবে।
বর্ণিত শর্তসমূহের মধ্যে কেউ ১, ২ ও ৬ সহ কমপক্ষে ৫ (পাঁচ)টি শর্ত পূরণ করলে তার নাম প্রাথমিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে। অধিকতর দরিদ্র অগ্রাধিকার পাবেন। প্রথম ও দ্বিতীয় গর্ভের সন্তান গর্ভাবস্থায় বা জন্মের ২ বছরের মধ্যে মারা গেলে তৃতীয় গর্ভধারণকালে ভাতা প্রাপ্য হবেন। একজন ভাতাভোগী জীবনে একবার ৫ (পাঁচ) বছর সময়কালের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা পাবেন। গর্ভপাতের কারণে নির্দিষ্ট চক্র অসম্পূর্ণ থাকলে তিনি পুনবায় গর্ভবতী হলে পরবর্তী ৫ (পাঁচ) বছরের মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রাপ্য হবেন, যদি অন্যান্য শর্ত পূরণ হয়ে থাকে।
গ) ১৮ বছরের আগে বিয়ে নয়, ২০ বছরের আগে সন্তান নয়Ñশর্ত ফলশ্রুতিতে বিবাহ নিবন্ধন, জন্ম নিবন্ধন, জন্ম নিয়ন্ত্রণ, বাল্যবিবাহ রোধ, মাতৃ দুধ পান, পুষ্টি খাদ্য গ্রহণ, বিশ্রাম, শ^শুর শাশুড়ীও সমাজে মর্যাদা বৃদ্ধি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা।
ঘ) সকল শিশু স্কুলে যায়, ঝরে পড়ে না, বিবাহ বিচ্ছেদ নেই, নির্যাতন নেই, প্রতিবন্ধী জন্ম হয় না। জেন্ডার সচেতনতা, দেশী ও বিদেশী বিভিন্ন মূল্যায়নে দেখা যায়, মাতৃত্বকালীন ভাতা কেন্দ্রিক স্বপ্ন প্যাকেজ বিনিয়োগ হস্তান্তরের অন্যতম সুফল। যে বিনিয়োগে কোনো লোকসান নেই। এতে একটি টেকসই স্বনির্ভর পরিবার তথা মাটিও মানুষ মালিকানায় পরিপূর্ণতা পাবে।
ঙ) মাকে কেন্দ্র করেই সকল ক্রিয়া-প্রক্রিয়া সংস্কার করতে হবে। উন্নয়ন-অধিকার মা’র গর্ভাবস্থা (তলরেখা’-বটম লাইনিং) থেকেই ধরতে বা শুরু করতে হবে। মা-ই নার্স, ডাক্তার, শিক্ষক, হিসাববিদ, অর্থনীতিবিদ, কি নয়? শিশু, কন্যা, কিশোরী, যুবতী, মহিলা, নারী, বৃদ্ধা যে শ্রেণিকেই চিহ্নিত বা টার্গেট করি না কেন, মা-কে কেন্দ্র করলেই প্রকৃতিগত ও স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এগিয়ে চলবে। তাহলেই বিভাজন ও বৈষম্যের উৎপত্তি বন্ধ হবে। কন্যা বা পুত্র সন্তান যাই হোক, কোনো শিশু ধনী বা গরিব হয়ে জন্মায় না।
চ) এক প্রজন্ম শেষে যাতে বলা যায়, বাংলাদেশে কেউ স্বাস্থ্যহীন, শিক্ষাহীন, ঘরহীন, কর্মসংস্থানহীন নেই। পরিবেশ ও সঞ্চয়ে বৈষম্যহীন দেশ গড়ার ভিত তৈরি হয়।
নারীবিষয়ক কমিশনকে এসডিজি প্রাধান্যে ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ অন্তর্ভুক্তিতায় ‘একের ভেতর সতের-র’ সফল অনুশীলন ও বাস্তবায়নকৃত কর্মসূচি কর্মপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্তির জন্য অনুরোধ জানাই।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা র্ডপ, গুসি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার বিজয়ী
[email protected]
