ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০১ মার্চ ২০২৫, ১৭ ফাল্গুন ১৪৩১

স্বাধীনতার সূচনা

ড. মো. শফিকুল ইসলাম

প্রকাশিত: ১৯:৪৭, ১ মার্চ ২০২৫

স্বাধীনতার সূচনা

অগ্নিঝরা মার্চ আমাদের মুক্তি ও স্বাধীনতার মাস। যে মার্চে গর্জে উঠেছিল বাংলার নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষ। বাংলাদেশ নামক দেশ সৃষ্টির ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম ঘটনা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। যে যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বা মানচিত্র পেয়েছি। যা সত্যিকার অর্থে আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের সামাজিক-রাজনৈতিক স্বপ্নসাধ ও লক্ষ্য পূরণ হয়। যা বিশ্বের ইতিহাসে স্মরণীয় ও বিরলও বটে। ১ মার্চ ১৯৭১ থেকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সূচনা হয় বলা যেতে পারে। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে এক সভায় গৃহীত প্রস্তাবে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ওই দিন পল্টনে জনসভা ও মিছিল শেষে ভাষণ দেন শেখ মুজিবুর রহমান। সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য জনগণের প্রতি নির্দেশ দেন। ৪-৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন আধাবেলা হরতাল পালিত হয়। ১৯৭১ সালের ৫ মার্চ আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ করেন ঢাকা ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
মহান স্বাধীনতার মাসের প্রথম দিন ১ মার্চ। বাঙালি জাতির গৌরবের মাস। আনুষ্ঠানিকভাবে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাস। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ। এ মাসেই পাকিস্তানি অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্বে এসে শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সাবেক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ভাষণে পাকিস্তানি শাসকদের হুঁশিয়ারি দেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে আগুন জ্বলে উঠেছিল, সে আগুন সম্পূর্ণভাবে ছড়িয়ে পড়ে বাংলার সর্বত্র। এরপর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা এবং ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সিঁড়ি বেয়ে একাত্তরের মার্চ বাঙালির জীবনে নিয়ে আসে নতুন দিগন্ত।
শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতির মূল সনদ ও বাংলার মানুষের অনন্য প্রামাণ্য দলিল। ৭ মার্চ ১৯৭১ রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। ঐ দিনে বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডের বীজ বপন হয়েছিল। ৭ মার্চে শেখ মুজিব ১৮ মিনিটের যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তার মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগাম ইঙ্গিত ছিল। ১৮ মিনিটের ভাষণে দেশ ও মানুষের জন্য সব ধরনের নির্দেশনা ছিল। যেমনÑ স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার, শৃঙ্খলা, শান্তি ও অসাম্প্রদায়িকতা। ১৯৭১ সালে ১৩ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ ১১৫ নং মার্শাল ল’ আদেশ জারি করে। প্রতিরক্ষা খাতে চাকরিরত সকল কর্মচারীকে ১৫ মার্চ সকালে কাজে যোগদানের জন্য নির্দেশ দেয়। কাজে যোগ না দিলে তাদের চাকরি চলে যাওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়। এ নির্দেশকে উস্কানিমূলক বলে অভিহিত করা হয়। যার ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ১৪ মার্চ শেখ মুজিব ৩৫ দফাভিত্তিক দাবিনামা পেশ করেন। পরে ১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকা সফরে আসেন এবং তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেন।
এভাবে একটি স্বাধীন দেশ, একটি পতাকা, একটি মানচিত্র, একটি জাতীয়তার পরিচয় এবং একটি ভূখণ্ড আমরা পাই। অন্যথায় আমাদের হয়তোবা আজীবন শোষিত ও পরাধীন থাকতে হতো। তাই একাত্তরকে কোনোভাবেই মুছে ফেলা যাবে না। ১৯৭১-এর তাৎপর্য অনেক ও গুরুত্বপূর্ণ। তরুণ প্রজন্মকে ১৯৭১-এর চেতনা ধারণ করে দেশের কল্যাণে কাজ করে যেতে হবে।
১৯৭১ সালের ২০ মার্চ শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যে সোয়া দুই ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা হয়। প্রথমে মনে হয়েছিল কিছুটা পজিটিভ সমাধান হতে যাচ্ছে। কিন্তু এটা ছিল ওদের কূটকৌশল। শেখ মুজিব ভুল করেননি। বিচক্ষণতার সঙ্গে তিনি আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণভাবে চালিয়ে যেতে বলেছিলেন। বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায় যে, তিনি কতটুকু সতর্কতার আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। ১৯৭১ সালের ২১ মার্চ শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যে ৭০ মিনিটের অনির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন তাজউদ্দীন আহমেদ। ১৯৭১ সালের ২২ মার্চে হঠাৎ জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় আসেন এবং জুলফিকার আলীর উপস্থিতিতে শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যকার আলোচনা হয়। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ শেখ মুজিব ছুটি ঘোষণা করেন এবং সকল সরকারি-বেসরকারি অফিস বা ভবনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ শেখ মুজিবের পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠক তিনি কোনো প্রকার নতিস্বীকার না করে কঠোরভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন এবং তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ চালানোর নির্দেশ দিয়ে যান। এটাই ছিল ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা। এমন পরিস্থিতিতে রাত ১২.২০ মিনিটে ইংরেজিতে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ স্বাধীনতার প্রথম প্রহরে রাত ১.২০ মিনিটে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল তখনকার ৩২নং সড়কের বাড়িতে হানা দেয় এবং স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়ার অপরাধে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। খবরটি ২৫টি দেশের গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
এর মধ্যেই তৎকালীন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কয়েকজন বেতারকর্মী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বাংলার জনগণকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতে তারা বেতারের মাধ্যমে কিছু প্রচার করবেন। তবে তারা নিরাপত্তার কারণে আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রকে কাজে না লাগিয়ে শহর থেকে কিছু দূরে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে চলে যান এবং ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে প্রথম প্রচার করেন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি’। সে সময়েই এম এ হান্নান শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণাটি আবার পাঠ করেন। প্রায় ১ ঘণ্টা অনুষ্ঠান করার পর তারা পরদিন সকাল ৭টায় পরবর্তী অনুষ্ঠান প্রচারের ঘোষণা দিয়ে সেদিনের পর্ব শেষ করেন। এরপর তারা ২৭ মার্চ সকালে বেতার কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পাহারা বসানোর উদ্দেশ্যে পটিয়ায় অবস্থানরত মেজর জিয়াউর রহমানের নিকট এ বিষয়ে সাহায্য চাইতে যান। সেখান থেকে তারা জিয়াউর রহমানকে সঙ্গে করে কালুরঘাট ফেরত আসেন। সেদিন অর্থাৎ ২৭ মার্চ রাত ৮টায় এক নতুন লিখিত ও সম্প্রসারিত বক্তব্যের মাধ্যমে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
মার্চ মাসে মুক্তিযোদ্ধারা নানা ষড়যন্ত্র অতিক্রম করে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে সকল সাম্প্রদায়িকতা রুখে একটি সুন্দর ও স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন। মার্চ মাস ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এক মহান ত্যাগের মাস আর অন্যদিকে বাংলার মানুষের জন্য ছিল এক লক্ষ্য বাস্তবায়নের মাস। তখন সকল প্রচেষ্টা ছিল দেশকে স্বাধীন করার। তাই ১৯৭১কে দেশ গঠনে স্মরণ করা আমাদের সকলের এক ধরনের নৈতিক দায়িত্ব। ১৯৭১-এর আদর্শকে ধারণ করে আমরা যেন সোনার বাংলাদেশ গড়তে পারি, এটাই হোক মার্চ মাসে আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

×