ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০১ মার্চ ২০২৫, ১৭ ফাল্গুন ১৪৩১

বৈষম্য ও সংস্কার প্রসঙ্গে

ড. মো. আবু তাহের

প্রকাশিত: ১৯:৪১, ১ মার্চ ২০২৫

বৈষম্য ও সংস্কার প্রসঙ্গে

সম্প্রতি দেশে ‘বৈষম্য ও সংস্কার’  দুটো শব্দ সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-এর স্বায়ত্তশাসনের দাবি, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধÑ সবই প্রকৃতপক্ষে বৈষম্যের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ। মূলত বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন বাংলা ভাষার প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে, ’৬৬’র আন্দোলন পূর্ব বাংলার প্রতি পাকিস্তানি শাসকদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান রাজনৈতিকভাবে বাঙালিদের দাবিয়ে  রাখার বিরুদ্ধে জনরায় বললে ভুল হবে না। একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন এবং সশস্ত্র  মুক্তিযুদ্ধ এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল। স্বাধীনতাউত্তর থেকে বর্তমান পর্যন্ত যত ধরনের আন্দোলন-সংগ্রাম-গণঅভ্যুত্থান পরিচালিত হয়েছে, তা অতীতে সংঘটিত গণআন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয় বরং  এরই ধারাবাহিকতা মাত্র।
এটা সত্য যে, স্বাধীনতাউত্তর ৫৩ বছরে দেশের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। সামাজিক-অর্থনৈতিক সূচকে সমকক্ষ দেশগুলো থেকে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। তথাপি বৈষম্য, দ্রব্যমূল্যের অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি,  মবোক্রেসি,  দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়ম নিয়ে এখনো কোনো না কোনো  সংবাদ প্রতিদিন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে, যা বেশ উদ্বেগের।
বর্তমানে বৈষম্য পরিমাপের গিনি সহগ অনুযায়ী বাংলাদেশ উচ্চ আয় বৈষম্যের দেশ হিসেবে চিহ্নিত। বৈষম্যের মূল কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্রনি ক্যাপিটালিজমের মাধ্যমে যেমন একটি সুবিধাবাদী শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছে তেমনি দুর্বৃত্তপরায়ণ রাজনীতিবিদ,  সামাজিক-বেসামরিক আমলা ও ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে একটি অলিগার্ক তৈরি হয়েছে। এই ধরনের আয় বৈষম্য ও সম্পদের পুঞ্জীভূতকরণ মুজিবনগর সরকার কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। গণমাধ্যমে এও এসেছে, বাংলাদেশে কোটিপতি/ বিলিনিয়ারের সংখ্যা গাণিতিক হারে বাড়ছে। ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে দুটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যা একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর অনেকে প্রথমে বাংলাদেশের সংবিধান, রাষ্ট্রনীতি, মুক্তিযুদ্ধের পরম্পরা, নির্বাচন ব্যবস্থাসহ সবকিছু নতুনভাবে গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেও শেষ পর্যন্ত তা সংস্কারের পথেই এগোয়। তারই ধারাবাহিকতায় সরকার বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। অনেক কমিশন ইতোমধ্যে রিপোর্ট জমা দিয়েছে। অন্য কমিশনগুলো শীঘ্রই রিপোর্ট জমা  দেবে। ইতোমধ্যে রিপোর্টগুলোকে সমন্বয় করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে এবং এর কাজও রয়েছে চলমান।
উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালে প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদের  নেতৃত্বাধীন  প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বাংলাদেশের ২৫৫ সেরা পেশাদার ব্যক্তির সমন্বয়ে ২৯টি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। টাস্কফোর্সগুলো বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত, সংশ্লিষ্ট  বিধি-বিধান-নিয়মাবলী বিশ্লেষণপূর্বক যথাসময়ে তাদের প্রতিবেদন জমা দেন। পরবর্তীতে ২৯টি টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনগুলো  চারটি খণ্ডে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ কর্তৃক  প্রকাশিত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনগুলোর সুপারিশ পরবর্তী সরকারগুলো তেমন আমলে নেয়নি। এমনকি ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সংস্কার নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসন ও সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও পরিতাপের বিষয় শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের কোনো প্রয়াস এখনো আমাদের চোখে পড়েনি। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন স্তরে বিদ্যমান বিভাজিত  শিক্ষা পদ্ধতি ও শিক্ষা পাঠ্যক্রমে বিভাজিত সমাজই তৈরি হবে, এটা নিঃসন্দেহে  বলা যায়। এতে আগামীতে  বৈষম্য বাড়বে বৈ কমবে না। বিষয়টি ভেবে দেখা অতীব জরুরি।
মূলত ১৯৭২-এর সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈষম্য সৃষ্টির কোনো সুযোগ নেই। সংবিধান যথাযথভাবে অনুসরণ না করা কিংবা এর  অপপ্রয়োগের ফলে দেশে বিভিন্ন ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে বিভিন্ন ধারা-উপধারা বলা হয়েছে : ১৯.(১) সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট  হইবেন। (২) মানুষে মানুষে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধা দান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। ২০.(২) রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টি করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসেবে কোন ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে পারিবেন  না। ২৭.সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান  এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। সংবিধানের এইসব ধারা ও উপধারা থেকে স্পষ্টভাবে  প্রতিয়মান হয় যে, গত অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কর্তৃত্ব করতে গিয়ে যারাই ‘বৈষম্য’ করেছেন, তারা সবাই ১৯৭২-এর সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। এমনকি নিজেদের স্বার্থে সংবিধানকে  অনেকবার কাটা-ছেঁড়া কিংবা  সংশোধন পর্যন্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় বিরাজমান বৈষম্য, সামাজিক অস্থিরতা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়ম থেকে উত্তরণের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন। তবে তা হতে হবে দল-মত- নির্বিশেষে সকলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে। পাশাপাশি আমলাতন্ত্রকে গণমুখী করার জন্য প্রয়োজন আমূল সংস্কার। তা না হলে বৈষম্যের অবসান ও সংস্কারের কোনো  উদ্যোগই আগের ন্যায় আলোর মুখ দেখবে না। কিংবা কোনো এক পর্যায়ে গিয়ে সংস্কার কার্যক্রম থমকে যাবে।
দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৩০ লাখ শহীদ, ২ লাখ মা-বোনের চরম আত্মত্যাগ, অগণিত মুক্তিযোদ্ধা ও সর্বসাধারণের অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে দেশ। শত চেষ্টা করেও এই ধারাবাহিক ইতিহাস কোনোদিন মুছে ফেলা যাবে না।
স্বাধীনতাউত্তর আজ অবধি বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে প্রতিবারই নিত্যনতুন স্লোগান এসেছে, প্রতিবারই ভেঙেছে দুয়ার, হয়েছে জ্যোতির্ময়। এভাবে ভেঙে ভেঙে  ও বাধা-বিপত্তি ডিঙিয়ে আমরা ক্রমাগত এগিয়েছি। কিন্তু অনেক স্বপ্ন এখনো অধরাই রয়ে গেছে। আশাবাদী মানুষ হিসেবে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, আগামীতে আমরা  মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্র অনুযায়ী সর্বক্ষেত্রে বৈষম্যের অবসান, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাসহ সুশাসন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বলিয়ান, অন্তর্ভুক্তিমূলক-জ্ঞানভিত্তিক-স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক- সহনশীল-ন্যায্যতাভিত্তিক একটি মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব অবশ্যই।

লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×