
সিয়াম সাধনার মাস মাহে রমজানের শুভযাত্রা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য ইবাদত বন্দেগির অনন্য সময়। সারা বছর অপেক্ষমাণ থাকা সময়ের নির্মাণে রমজান মাস তার সমস্ত আবেদন-নিবেদন নিয়ে হাজির হয়। ইসলাম ধর্মের পবিত্রতম অনুভবে ফরজ হিসেবে রোজার মাহাত্ম্য সত্যিই এক অবশ্য পালনীয় আল্লাহর বিধি। তার আগে আকাশে চাঁদ দেখা ও উৎসুক মুসলমানদের জন্য ভিন্নমাত্রিক ভাবাবেগ। আর রমজান মানেই বাড়তি ইবাদত। খাবারের সময়েও থাকে ভিন্ন মাত্রার রদবদল। সেখানে সকালের নাশতা আর দুপুরের খাবারের জায়গায় যেতে হয় ভোররাতে। সুবাহ্ সাদিকের আগে। অর্থাৎ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজার যথার্থ সময় হিসেবে গণ্য করা হয়। আবার এই রমজান মাসে যুক্ত হয় বাড়তি ইবাদত। যা তারাবির নামাজ হিসেবে ধর্মে লিপিবদ্ধ আছে। যা সেহরি খাওয়া পর্যন্ত সময় দেওয়া থাকে। তারাবির নামাজ মূলত পুরুষরা মসজিদে গিয়ে আদায় করেন। আর নারীরা সাধারণত ঘরে বসেই। আবার অনেকেই কয়েক পরিবার মিলে নারীরা একত্রিত হয়ে তারাবির নামাজ পড়তে দেখা যায়। যে কোনো ওয়াক্তের কিংবা সময়ের নামাজ যদি জামাতে পড়া যায় তার মাহাত্ম্য ভিন্ন মাত্রার বলে মুমিন মুসলমানরা অনুভব, অনুভূতিতে লালন ধারণ করেন। তবে সবচেয়ে গুরুত্ববহ কিন্তু নামাজ আর রোজায় নিজেকে সম্পূর্ণ উজাড় করে দেওয়া। এক মাসের তারাবি আর শবেকদরের পুণ্যতম রজনীকে যেভাবে ধর্মে ফজিলত দেওয়া আছে তা মুমিন মুসলমানদের জন্য পরম শিক্ষণীয় বিষয়। সেটা শুধু ইহকালের ইবাদতই নয় পরকালের জন্যও সঞ্চিত পরম সওয়াবের অনন্য নির্মাল্য। আমরা জানি ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। যা সূর্যোদয় থেকে পশ্চিমগগনে হেলে পড়া অবধি। নিত্যদিনের অপরিমেয় আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক অনন্য শুভ সম্মিলন। ২৯ কিংবা ৩০ দিনের এই পরম মাহাত্ম্য সারা বছরের ইবাদত বন্দেগির চেয়েও মহামূল্যবান। পরম করুণাময়কে নিকটবর্তী করার এক অভাবনীয় যোগসাজশ। শুধু কি ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল থাকা? যা কি পরিপূর্ণ এক যাপিত জীবন তা শুধু সওয়াবের মধ্যে শেষ হয়ে যায় না। রোজার যেমন ফজিলত আছে একইভাবে নিত্য জীবনের দিকনির্দেশনায়ও বিভিন্ন বিধিনিষেধ থাকে। যা ইসলাম ধর্মেরই অনুষঙ্গ।
মূলত আহারের সময় সেহরি আর ইফতার। যেখানে স্বাস্থ্যসম্মত, হজমযোগ্য, সহনীয় খাবারই নির্দেশ করা আছে। আমরা সবাই ভাবতে বসি ছোলা, পেঁয়াজি, বেগুনিসহ বিভিন্ন তৈলাক্ত খাবার আর একটা মিষ্টি জাতীয় কোনো সুস্বাদু খাদ্য। চিনি, চাল, আটা, তেল মানেই স্বাস্থ্যহানির কিছু উপাদান তো বটেই। সঙ্গত কারণে গৃহকর্তা কিংবা কর্ত্রীর নজর থাকে কার্বোহাইড্রেড, শর্করা, তৈলাক্ত জাতীয় খাবারের আয়োজনে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা। তবে বর্তমানে অনেকেই শারীরিক সুস্থতায় একটু নমনীয়, সহনীয় খাদ্য তালিকায় ঝুঁকছেন। যেমন দই-চিড়া, মুড়ি শুধু স্বাস্থ্যসম্মতই নয় হজমেও থাকে শারীরিক অনুকূলতা। আর কলার মতো সহজলভ্য ফলের উপকারিতা সত্যিই চমকপ্রদ এক উপহার। তবে তেলসমৃদ্ধ খাবার ইফতার সামগ্রি কম থাকাই শ্রেয়। সেখানে চিড়া, দই-ই উত্তম হজমসাধ্য আহার হিসেবে বহুল প্রচলিত এবং নিত্য খাদ্য অভ্যাসের পরম স্বস্তিদায়ক বিষয়ও বটে।
পবিত্র রমজান মাস শুধু ইবাদত বন্দেগির মাস বললে কিছু প্রয়োজনীয় বিষয় তো বাদ পড়ার আশঙ্কা নাড়া দেওয়ার মতোই। যেমন প্রত্যেক শিশু, অসুস্থ এবং বয়োবৃদ্ধ মানুষের উপস্থিতিও পারিবারিক সম্প্রীতির এক অভাবনীয় পরিপূর্ণতা। বিশেষ করে যা আমাদের উর্বর পলিমাটির বরেন্দ্র অঞ্চলের এক চমৎকার বন্ধনের নির্মাল্য। সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা আবহমান বঙ্গভূমি মিলনগ্রন্থিতে আবদ্ধ অষ্ট্রিক জাতি গোষ্ঠীর যুগ-যুগান্তরের পরম ঐশ্বর্য। যেখানে বীজ মাত্রই ফসলে বঙ্গজননীর মাঠ আলো করা খাদ্যের চিরায়ত সম্ভার। ছায়া ঘেরা, সুনিবিড়, শান্তির নীড়ের বাসিন্দারা পরম আত্মীয়ের মতো নিজের জন্মভূমিকে লালন ধারণ করে তাও অঞ্চলভিত্তিক এই শ্যামল বাংলার অভাবনীয় রূপ শৌর্য। কিন্তু মাথা উঁচু করে আপন ঐতিহ্যিক বেড়াজালে স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে অপরাজেয় শক্তিমত্তায় আবর্তিত লড়াকু জাতি। ব্রিটিশরা দখল করার আগ পর্যন্ত স্বমহিমায় আপন ঐতিহ্যে টিকে থাকার অদম্য এক বিপ্লবী সত্তা। কিন্তু ধর্মপ্রাণ ও অসাম্প্রদায়িক জাতি হিসেবেও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ এক অসম সাহসিকতার দুর্জয় শক্তি। তবে শুধু ধর্মপ্রাণ কিংবা মুমিন মুসলমান নয় বরং ধর্ম, বর্ণের মিলনগ্রন্থিতে সহিষ্ণুতার পরম সত্তায় শঙ্কর জাতির মর্যাদায় স্থান পাওয়া আর এক দুর্বার পালাক্রমের অংশীদারও বটে।
রমজানের সারা মাসের মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে আমরা সম্প্রীতির পরম বন্ধনে পরিবারের শিশু, অসুস্থ পিতা-মাতা কিংবা বয়োবৃদ্ধ মানুষদের যেন অবহেলা, অবজ্ঞায় দূরে সরিয়ে না রাখি। শিশুদের জন্য আলাদা খাবারই শুধু নয় যত্ন আত্তিরও বিশেষভাবে নাড়া দেয় অন্যান্য সদস্যদের। বিশেষ করে গৃহিণী জায়া, জননীদের। বয়সের ভারে অবনত অনেকেই বিভিন্ন রোগেও কাহিল থাকেন। বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপ, বহুমূত্র রোগ। যা কি না একেবারেই চিকিৎসানির্ভর। ওষুধ সেবনও নিত্য যাপিত জীবনের অংশই বলা যায়। রোজা রাখতে ইফতার কিংবা সেহরির সময় ওষুধ সেবন করে রমজান মাসের ধর্মীয় বিধি পালন করতে পারেন তাদের জন্য আলাদা কার্যক্রমের প্রয়োজনই পড়ে না। কিন্তু যাদের সকালের নাশতা আর মধ্যাহ্ন ভোজনের দরকার হয় সেখানে ঘরের কর্ত্রীকে বাড়তি নজর দেওয়া যেন পরিস্থিতির অপরিহার্যতা। অসুস্থ আর বয়োবৃদ্ধি মানুষ যখন রোজা, নামাজের জন্য হিমশিম খেতে থাকেন তখন তাদের যন্ত্রণাকাতর অনুভব পারিবারিক আবহের এক কষ্টকর বিষয়। তার পরও সিয়াম সাধনার এই পরম মাসটি সংশ্লিষ্টদের শুভ কর্ম পথে ধরনির্ভর গানের মতো যেন সর্বান্তকরণে ভেতরের বোধে জিইয়ে থাকে। যা তাদের নানামাত্রিকে উদ্বেলিত, আনন্দিত আর অতি অবশ্যই আধ্যাত্মিক চেতনায় নিমগ্নও করে রাখে। আবার কি ভাবে মাসটি তার অন্তিম সময়ে চলে আসে খোদাভক্ত মানুষ টেরই পায় না। দেখতে দেখতে যেন পবিত্র ক্ষণের নির্মাল্য যতই মাসব্যাপী হোক সময়ের কাটার মতো যেন দ্রুততার সঙ্গে চলেও যায়। শেষ অবধি সামনের মাহে রমজানের জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা। অনেক মুমিন মুসলমানের চোখ অশ্রুসিক্ত হয় নয়ন ভরা জলে ভাবতে বসেন সামনে রোজা রাখা যাবে তো? সুস্থ-অসুস্থতার প্রশ্ন থেকেই যায়। বাঁচা-মরা নিয়েও হৃদয়ের নিভৃতে ঝড় ওঠে। মাহে রমজানের বিদায় দেওয়া আসলে অত সহজ বিষয় নয় বরং অপেক্ষমাণ থাকাকেই শ্রেয় মনে করেন। দিন গোনা শুরু হয়ে যায়। সেভাবেই প্রতি বছর রমজান আসে তার সর্ববিধ মাহাত্ম্য আর পরিশীলিত ইবাদত বন্দেগির নানামাত্রিক আবেদন নিয়ে। সুস্থ মানব জীবনের সবচেয়ে বড় ফজিলত ইবাদতে মশগুল থেকে রমজানে যথার্থ আবেদনে মশগুল হওয়া।