
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ও শ্রেণিবিভাজন বিশ্লেষণ করতে গেলে, আমাদের দেখতে হবে কিভাবে দেশের সম্পদ বণ্টিত হচ্ছে এবং এই বণ্টন থেকে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি কতটা উপকৃত হচ্ছে বা বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশের সমাজ, অর্থনীতি এবং শ্রেণিবিভাগ একে অপরের সঙ্গে জড়িত এবং এটি সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে গভীর প্রভাব ফেলে। এই প্রেক্ষাপটে ধনী, দরিদ্র, মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত, নি¤œ-মধ্যবিত্ত, এবং অতি-দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে সম্পর্ক এবং তাদের অবস্থান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে, বর্তমান বাংলাদেশে শ্রেণিভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামোতে কিছু বিষয় স্পষ্টভাবে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এই অসামঞ্জস্য দেশের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি এবং সামাজিক শান্তির জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্যভাবে ১০ শতাংশ মানুষই দেশের সম্পদের প্রায় ৯০ শতাংশের মালিক। এই ১০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে বড় ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, জমির মালিক, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা। এই শ্রেণি তাদের অবস্থান ধরে রাখতে এবং আরও উন্নত করতে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সুবিধা ব্যবহার করে থাকে। তাদের অর্থনৈতিক আধিপত্য এতটাই প্রভাবশালী যে, এটি প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়Ñ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি, আইন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে। উদাহরণস্বরূপ, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদান, বিশেষ ব্যবসায়ী সংস্থাগুলোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ সুবিধা বা ট্যাক্স কমানো, বা একাধারে জমির মালিকানা এবং ব্যবসায়িক পরিকল্পনায় সরকারি নীতি গ্রহণ করা। ফলে, তারা সরকারের নীতি এবং সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে নিজেদের লাভের জন্য কাজ করায়।
ধনী শ্রেণি তাদের বিপুল পরিমাণ সম্পদের মাধ্যমে সমাজে বৃহৎ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে, যেখানে তাদের মতো মানুষেরাই ক্ষমতার শীর্ষে থাকে। এটি একদিকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে পারে, কিন্তু অন্যদিকে এটি বৈষম্য ও অসাম্যতা তৈরি করে। যেখানে প্রায় সব সমাজের জনগণ এই সুবিধাগুলো পেতে সক্ষম হয় না। এই অবস্থায়, দেশে ধনিক শ্রেণি একটি শক্তিশালী শক্তি হিসেবে কাজ করে, যা সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক স্তরেও প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্য প্রান্তে রয়েছে দরিদ্র ও অতি-দরিদ্র শ্রেণি, যারা প্রায় ৯০ শতাংশ জনগণের মধ্যে পড়ে এবং দেশের সম্পদের মাত্র ১০ শতাংশের মালিক। এই শ্রেণির অধিকাংশ মানুষের জীবিকা নির্বাহের জন্য নির্ভর করতে হয় দিনমজুরি, কৃষি, ছোট ব্যবসা বা অল্প আয়ের কাজের ওপর। এই শ্রেণির মানুষের অধিকাংশই মৌলিক চাহিদা পূরণে সংগ্রাম করছে। তাদের জন্য উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং বসবাসের স্থান নিশ্চিত করা একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় এবং সরকারি সহায়তা অনেক সময় তাদের কাছে পৌঁছায় না। অনেক সময় সরকারি নীতির বাস্তবায়নও ধনী শ্রেণির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সমঝোতার কারণে কার্যকর হয়ে ওঠে না।
এখনো অনেক দরিদ্র পরিবার ভরণ-পোষণের জন্য ঋণের ওপর নির্ভরশীল, যা তাদের দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনাকে আরও সংকুচিত করে। তাদের অধিকাংশই স্বল্প আয়ের কাজ বা কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত, যা আয়ের অস্থিরতা সৃষ্টি করে। এই শ্রেণি নির্ভরশীল সামাজিক নিরাপত্তা নেট, যেমনÑ স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা বা অন্যান্য সরকারি সুবিধা। যা তারা প্রাপ্য তা খুবই সীমিত এবং অনেক সময় এই সুবিধাগুলো কেবল সীমিত জনগণের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়, যারা রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির দ্বারা সুবিধা পায়। ফলে, দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা প্রবল হয়ে ওঠে, যা দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে।
বাংলাদেশে ‘মধ্যবিত্ত’ শব্দটি বেশ প্রচলিত হলেও, এর মধ্যে রয়েছে এক ধরনের বিভ্রান্তি। বাংলাদেশে ‘মধ্যবিত্ত’ বলতে অনেক সময় এমন একটি শ্রেণির কথা বলা হয় যারা না ধনী, না দরিদ্র, বরং একটি মধ্যপথে অবস্থান করছে। তবে বাস্তবে এই শ্রেণির জীবিকা অনেক সময় ঝুঁকিপূর্ণ এবং ভঙ্গুর হয়ে থাকে। বর্তমানে, বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি ঋণ বা জীবিকার সংকটের শিকার হচ্ছে, যা তাদের আয় এবং জীবিকার নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তাদের বড় একটি অংশ ক্রমশই তাদের আয়ের নিরাপত্তা হারিয়ে ফেলছে এবং উচ্চ জীবনের মানের স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবতার মধ্যে বৈষম্য দেখা যাচ্ছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিশেষত শহুরে অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। যেখানে একদিকে তাদের জীবিকার পরিসর ও আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরদিকে তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা ভোগ করছে। এই শ্রেণি তাদের জীবিকার জন্য বেশিরভাগ সময় ঋণের ওপর নির্ভরশীল থাকে, যা তাদের দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার পথকে আরও বন্ধ করে দেয়। তারা যেমন সুবিধা পেতে সক্ষম নয়, তেমনি তাদের জীবনযাত্রা খুবই অস্থির এবং পরিবর্তনশীল। তারা বিশেষ সুবিধা পাওয়ার সুযোগ পায় না এবং সেই সঙ্গে তারা ধনী হওয়ার সুযোগও খুঁজে পায় না। বরং ক্রমশ তাদের অবস্থান আরও অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের সমাজে শ্রেণীভিত্তিক বিভাজন শুধু অর্থনৈতিক স্তরে নয়, এটি গভীরভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক স্তরেও প্রভাব ফেলছে। ধনী শ্রেণির প্রভাব ও ক্ষমতা দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকেও প্রভাবিত করে। রাষ্ট্রের নীতিমালা, আইন এবং সরকারি সেবা অনেক সময় তাদের সুবিধার্থে পরিবর্তিত হয়। অন্যদিকে, দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে সংগ্রাম করছে। তারা সঠিকভাবে সুরক্ষা বা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না।
এই সমাজের অসমতামূলক পরিস্থিতি দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতে অসামঞ্জস্য তৈরি করছে। যার ফলে বহু মানুষ বৈষম্য, দারিদ্র্য এবং অসচ্ছলতার শিকার হচ্ছে। দেশে যখন সমাজে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা বা সরকারি সহায়তার সুযোগ সীমিত হয়, তখন এটি রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি করে। কয়েক শ্রেণির মধ্যে এক ধরনের বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি হয়, যা সমাজের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে সরকারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে একটি সমতাভিত্তিক নীতি প্রণয়ন, যাতে দেশের সম্পদ ধনী শ্রেণির কাছ থেকে বিতরণ করে দরিদ্র শ্রেণির জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। এটা শুধু অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও সমৃদ্ধির বণ্টন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতে পারে। সরকারি নীতিতে এমন পরিবর্তন আনা প্রয়োজন যাতে দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং দুর্নীতি হ্রাস পায় এবং সমগ্র সমাজের উন্নয়ন নিশ্চিত হয়। অতএব, বাংলাদেশে শ্রেণিভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামো শুধু একটি অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের বিষয় নয়, এটি দেশের সামাজিক শান্তি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : সাংবাদিক