ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৬ ফাল্গুন ১৪৩১

ঢাবির একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ: রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিকেন্দ্রীকরণই সমাধান

শফিকুল ইসলাম শফিক

প্রকাশিত: ১৫:৫৯, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ১৬:২৫, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ঢাবির একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ: রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিকেন্দ্রীকরণই সমাধান

ছবি: শফিকুল ইসলাম শফিক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) বাংলাদেশের ইতিহাস, রাজনীতি এবং সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। দীর্ঘ সময় ধরে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রাধান্য এবং নেতৃত্বের একচেটিয়া আধিপত্য লক্ষ্য করা গেছে। এই আধিপত্যের পেছনে একটি ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে, যা পরবর্তীতে রাজনীতির প্যাটার্নকে প্রভাবিত করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ছিল এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা থেকে। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি পূর্ব বাংলার মুসলিম জনগণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। তখনকার সময়ে পূর্ব বাংলার মুসলিমরা শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে পিছিয়ে ছিলেন, এবং তাদের উন্নতির জন্য একটি শক্তিশালী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত জরুরি ছিল। নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবনা আসে, যা পরবর্তীতে একটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, একাধিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন, ইয়াহিয়া বিরোধী আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ—সবই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল। এমনকি যুদ্ধ পরবর্তী স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ও ২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানেও ঢাবির ছাত্ররা প্রথম সারিতে ছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলো দীর্ঘকাল ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব নির্বাচনে প্রভাবশালী ভূমিকা রেখেছে। এটি এক ধরনের ঐতিহাসিক বাস্তবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। প্রায় সব রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক সংগঠন তাদের নেতৃত্বের জন্য ঢাবির শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেয়, কারণ ইতিহাসে ঢাবির শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে যে আন্দোলনগুলোর সফলতা এসেছে, তা এখনো রাজনীতির একটি নির্ধারক উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়।

তবে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, "এতদিন ধরে কেন শুধু ঢাবির একচেটিয়া প্রাধান্য?" রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই ধরনের একটি একগুঁয়ে দৃষ্টিভঙ্গি দেশ এবং জাতির স্বার্থে কতটা কার্যকর?

বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক চর্চার পরিবর্তন এবং নেতৃত্ব নির্বাচনের প্যাটার্নে পরিবর্তন আনার দাবি উঠেছে। একদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক ভূমিকা এখনও অপরিসীম, তবে অন্যদিকে, সময়ের সাথে সাথে দেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করছে। প্রযুক্তি, ব্যবসা, বিজ্ঞান এবং অন্যান্য শাখায় দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বিশেষজ্ঞ তৈরি করছে এবং এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতি বা সামাজিক আন্দোলনেও বেশ কিছু আগ্রহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হচ্ছে।

এটা পরিষ্কার যে, দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ অত্যন্ত জরুরি। বিভিন্ন অঞ্চলের এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নেতৃত্বের বণ্টন দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য স্বাস্থ্যকর হতে পারে। এককেন্দ্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার ফলে নেতারা একাধিক ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক দলকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন না। এটি সমাজের নানা স্তরের মানুষের অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সহায়ক হতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু দেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যত লক্ষ্য অনুসারে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। একচেটিয়া আধিপত্য কাটিয়ে আরও সমন্বিত এবং প্রশস্ত নেতৃত্ব নির্বাচনের পথ খোলা উচিত। এতে দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক কাঠামো আরও শক্তিশালী হবে এবং সাধারণ জনগণের অধিকারের স্বার্থে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।

এখন সময় এসেছে, ঐতিহাসিক বাস্তবতা থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি নতুন রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করার, যেখানে দেশের সব অঞ্চলের এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের সমান সুযোগ এবং নেতৃত্বে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে।

লেখক: শফিকুল ইসলাম শফিক
১ নং সহ- সাধারন সম্পাদক
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, কেন্দ্রীয় সংসদ।

ফারুক

×