
ভূমিকম্প কোনো ধরনের পূর্বাভাস না দিয়েই আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস কিংবা বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে হুঁশিয়ারি সংকেত পেলেও অথবা নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগ হলেও ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পেতে এ ধরনের কোনো সুযোগ পায় না মানুষ। কারণ, বিজ্ঞান ভূমিকম্প বা এ দুর্যোগের কাছে খুবই অসহায়। আগাম সতর্কবার্তা জানানোর উপায় এখনো খুঁজে পায়নি বিজ্ঞান। অবশ্য বিজ্ঞানীরাও বসে নেই, প্রতিনিয়তই গবেষণা করে যাচ্ছেন, কিভাবে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস মানুষকে জানানো যায়, সেই চেষ্টাই করছেন তারা।
ভূমিকম্প বিভিন্ন মাত্রার হয়। ধ্বংসলীলা ও দুর্যোগ শক্তির পরিমাপ বোঝাতে রিখটার স্কেলের মাত্রা ব্যবহার করা হয় ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে। যেমন ১ থেকে ১০ হচ্ছে রিখটার স্কেলের মাত্রা। রিখটার স্কেলের মাত্রা ৫-এর ওপরে গেলেই সেটাকে ভারী ভূমিকম্প বলা হয়। এভাবে একেক মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার মানেই হচ্ছে ১০ থেকে ৩২ গুণ শক্তি বৃদ্ধি পাওয়া। যেমন- ভূমিকম্পের মাত্রা ৫ থেকে ৫.৯৯ হচ্ছে মাঝারি, ৬ থেকে ৬.৯৯ তীব্র, ৭ থেকে ৭.৯৯ ভয়াবহ, ৮-এর ওপরে মহাদুর্যোগ। এই হচ্ছে রিখটার স্কেলের হিসাব। রিখটার স্কেলের হিসেব ছাড়াও ভূমিকম্প ছোট, মাঝারি ও বড় ধরনের আখ্যা দিয়ে থাকে অনেকেই। ভূমিকম্পের ধরন যেমনই হোক না কেন, মূলত সব ধরনের ভূমিকম্পই বিপজ্জনক। ছোট ধরনের ভূমিকম্প তেমন বিপজ্জনক না হলেও মাঝারি ধরনের ভূমিকম্পের তাণ্ডবে ঘরবাড়ি ভেঙে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট হয় এবং গ্যাসলাইন ভেঙে তছনছ হওয়ার পাশাপাশি জনপদে আগুন লেগে যায় অনেক সময়। আর বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে তো কথাই নেই, ভয়ংকর বিভীষিকা নেমে আসে ওই জনপদে। সেটি যদি সমুদ্রের তলদেশে ঘটে, তাহলেও রক্ষা নেই। জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপে উপকূল প্লাবিত হয়ে হাজার লক্ষ প্রাণের বিনাশ ঘটায়। যেমনÑ ২৬ ডিসেম্বর ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরের ৩০ কিলোমিটার গভীরে যে ভূকম্পন ঘটে, তাতে ১৪টি দেশের প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষ মারা যান। ওই ভূমিকম্প বিশ্বে ‘সুনামি’ নামে পরিচিতি পায়; যার পরিমাপ ছিল ৯.১ থেকে ৯.৩ মাত্রার রিখটার স্কেল। পৃথিবীর ইতিহাসে এই ভূমিকম্প দীর্ঘতম সময়ের ছিল; প্রায় ৮.৩ থেকে ১০ মিনিট এর স্থায়িত্ব ছিল। অন্যদিকে ১১ মার্চ ২০০৯ সালে জাপানে কয়েক সেকেন্ড স্থায়িত্বের বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানে, যার পরিমাপ ৮.৯ রিখটার স্কেল। ওই ভূমিকম্পের ফলে ওই তারিখের দিনের দৈর্ঘ্য ১.৮ মাইক্রো সেকেন্ড হ্রাস পেয়েছিল। তবে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে ১৯৬০ সালে চিলিতে। রিখটার স্কেলে ওই ভূমিকম্পের মাত্রা ৯.৫ রেকর্ড করা হয়েছিল, যার ফলে চিলিতে বিভীষিকাময় মহাদুর্যোগ নেমে আসে এবং ঘরবাড়ি ধ্বংসের পাশাপাশি অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায়। তারপর থেকে চিলি সরকার যেকোনো স্থাপনার অনুমোদনের ক্ষেত্রে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করে। চিলিতে বিল্ডিং কোড বাধ্যতামূলক করাতে পরবর্তী সময়ে এর সুফলও পেয়েছে দেশটি। দেখা গেছে, ৮ মাত্রার ভূমিকম্পেও দেশটির তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। মোটামুটি এই হচ্ছে জলে-স্থলে আঘাত হানা তিনটি বড় ধরনের ভূমিকম্পের পরিণাম। এ ছাড়া বড় ধরনের আরও কয়েকটি ভূমিকম্প বিশ্বে আঘাত হেনেছিল, যার ফলে জনপদ বিধ্বস্ত হওয়ার পাশাপাশি লাখ-লাখ প্রাণের সমাধি ঘটেছিল যুগে যুগে। সুতরাং বলা যায়, ভূমিকম্প অন্যান্য দুর্যোগের চেয়েও ভয়াবহ একটি দুর্যোগ। কারণ, এই দুর্যোগ শুধু মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীর জীবনই কেড়ে নেয় না, যে কোনো জনপদকেও বিলীন করে দেয়। অর্থাৎ সভ্যতাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার বড় ধরনের ক্ষেত্রই হচ্ছে ভূমিকম্প। এটি শুধু পৃথিবীতেই নয়, অন্যান্য গ্রহেও আঘাত হানে। ভূ-অভ্যন্তরে টেকটোনিক প্লেটের ওঠানামার কারণই হচ্ছে ভূকম্পন বা ভূমিকম্প। এছাড়া অগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ, শিলাচ্যুতি, তাপ বিকিরণের কারণেও ভূমিকম্প হয়। তবে সেই ধরনের ভূমিকম্প টেকটোনিক প্লেটের ওঠানামার মতো অতটা ভয়ংকর হয় না।
ভূমিকম্প যে কোনো মুহূর্তে আঘাত হানতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, সমগ্র বিশ্বে বছরে লাখ লাখ ভূমিকম্প হয়। এর মধ্যে অনেক কম্পন অনুধাবন করা যায় না। সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, বছরে গড়ে ১৭টি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়, রিখটার স্কেলে ওই ভূমিকম্পের মাত্রা ৭-এর ওপরে থাকে। আর ৮ মাত্রার ভূমিকম্প বছরে একবার হয়ে থাকে। তবে পৃথিবীতে যত ভূমিকম্প আঘাত হানে, তার ৯০ শতাংশই প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় ঘটে। ইতোপূর্বে বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প না ঘটলেও বর্তমানে বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে দেশটি। ভূতাত্ত্বিক জরিপে জানা যায়, বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান রয়েছে ৫ নম্বরে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে সিলেট ও পার্বত্যাঞ্চল। ঢাকার বিষয়টা ভিন্ন। ঢাকায় ভূমিকম্পের মাত্রার ওপর নির্ভর করবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। যেমনÑ গত সপ্তাহের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশা সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে না হয়ে যদি ঢাকায় হতো, তাহলে এই মাত্রার অর্থাৎ রিখটার স্কেলের ৫.১ মাত্রায় কম্পনের ফলেও ঢাকায়ও ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি হতো।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ভূমিকম্পে রিখটার স্কেলের মাত্রা ৭ ছাড়িয়ে গেলেই রাজধানী ঢাকা শহরের প্রায় ৭২ হাজার ভবন ধসে। আর ভূমিকম্পের মাত্রা ৮ ছাড়িয়ে গেলে শহরে দেড়-দুই লাখ লোকের মৃত্যু ঘটবে। এমনিতেই বাংলাদেশের অবস্থান ভারতীয়, ইউরেশীয় ও বার্মিজ তিনটি সক্রিয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। যার ফলে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ ও পার্বত্য অঞ্চলে প্রতিনিয়ত মৃদু ভূকম্পন অনুভূত হলেও মানুষ তা টের পায় না। সুতরাং বলা যায়, ভূমিকম্প মহাদুর্যোগ হয়ে যে কোনো সময় বাংলাদেশে বড় ধরনের আঘাত হানতে পারে। কাজেই আমাদের যথেষ্ট সতর্ক হতে হবে। ভবন নির্মাণ এবং যে কোনো ধরনের স্থাপনার ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড মেনে সঠিক গ্রাউন্ড মোশন নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে পুরনো ভবনকে টেকসইও মজবুতভাবে সংস্কার করতে হবে। খুব বেশি পুরনো দালান বা ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে ফেলতে হবে। ঢাকা শহরের জন্য বিষয়টি আরও ভয়ংকর হতে পারে। ভূমিকম্প ৭ মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে রাজধানী ঢাকা শহরের চিত্র পাল্টে যাবে। ঘনবসতি ও জনবহুল এই শহর তখন হতে পারে মৃত্যুপুরী। কাজেই এখনই সতর্ক হতে হবে সবাইকে। টেকসই স্থাপনা নির্মাণের পাশাপাশি ঘনবসতি ভবন নির্মাণ প্রতিহত করতে হবে। তাহলে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে।
লেখক : কথাসাহিত্যক ও
জলবায়ু বিষয়ক লেখক