
দেশের বিপুল জনসংখ্যাকে সম্পদে রূপান্তর করার প্রধান হাতিয়ার মানসম্মত শিক্ষা। দক্ষ মানব সম্পদের মাধ্যমে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সম্ভব। এ জন্যই জনসংখ্যার সংখ্যাগত দিকের চেয়ে গুণগত দিকটি অধিক তাৎপর্যপূর্ণ। মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নে অন্যতম একটি অন্তরায় হলো শিক্ষকদের বিষয় জ্ঞানের দীনতা। শিক্ষকদের বুনিয়াদি ও বিষয় জ্ঞানে পারদর্শী করতে না পারলে মানসম্মত শিক্ষা কখনো সম্ভব নয়। এ জন্য প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহির দুর্বল ব্যবস্থার জন্য শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষিতের হার বাড়ানোর পাশাপাশি শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। শিক্ষানীতিতে মানসম্মত শিক্ষার জন্য করণীয় বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়নে নেই জোরালো পদক্ষেপ। ১৯৯৬ সালে মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্রীদের উপবৃত্তি দেওয়া শুরু করে, যা পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত চালুর ফলে নারী শিক্ষায় অগ্রগতি হয়েছে। ২০১০ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বিনামূলে বই বিতরণের ফলে শিশু শিক্ষায় ঝরে পড়ার হারও কমেছে।
শিক্ষা মানব সম্পদ উন্নয়নের অপরিহার্য উপাদান হলেও শিক্ষায় অর্থায়ন হতাশাব্যঞ্জক। অথচ শিক্ষা খাতে প্রয়োজন অধিক বিনিয়োগ। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে কম। শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানো একান্ত প্রয়োজন। ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৭ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ রাখা দরকার। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) শিক্ষা, যুব বেকারত্ব ও যুব উন্নয়ন বিষয়ক আলোচনা থেকে জানা যায়, গত এক দশকে উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে বেকারের সংখ্যা। এত বেশি উচ্চ শিক্ষিত বেকার বিশ্বের অন্য দেশে খুব একটা দেখা যায় না। দেশে উচ্চ শিক্ষিত বেকারের সিংহভাগ আসছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, যা প্রায় ৬২ শতাংশ। এর অন্যতম কারণ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৩ শতাংশ শিক্ষার্থী সমাজবিজ্ঞান বা কলার মতো বিভিন্ন বিষয়ে পড়েন, যেগুলোর বাজার চাহিদা কম। তথ্যানুযায়ী, জাতীয় বেকারত্বের হারের তুলনায় ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় দ্বিগুণ। এই তরুণদের মধ্যে যারা আবার টারশিয়ারি তথা উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন, তাদের মধ্যে বেকারের হার সর্বোচ্চ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটা অংশ আবার স্বেচ্ছায় বেকার থাকেন। তারা সরকারি চাকরির জন্য ৩-৪ বছর ধরে অপেক্ষা করেন। উচ্চ শিক্ষিত বেকার বৃদ্ধির এটিও অন্যতম কারণ বলা যায়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় প্রায় ২ হাজার ৫০০ কলেজ রয়েছে বলে জানান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এসএম আমানুল্লাহ। এসব কলেজের গভর্নিং বডি আবার অনেক বেশি রাজনৈতিকভাবে সমালোচিত। শিক্ষার মান নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। যত্রতত্র পড়ানো হচ্ছে মাস্টার্স কোর্স। প্রযুক্তিগত শিক্ষা নিয়ে চলছে অরাজকতা। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এ যুগে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বেকারের সংখ্যা কমিয়ে আনা সহজ। শুধু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জোরালো পদক্ষেপ প্রয়োজন। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মমুখী বা কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ করতে হবে। এক্ষেত্রে দরকার সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলের দূরদর্শী পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন।