
প্রতিবছরই অমর একুশে বইমেলায় যাওয়া এক ধরনের নেশা
প্রতিবছরই অমর একুশে বইমেলায় যাওয়া এক ধরনের নেশা বললেও ভুল হবে না। কখনো যাওয়া হয় একাধিকবারও। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে ঘুরে বেড়ানো হয় এক স্টল থেকে অন্য স্টলে। ভাষার মাস উপলক্ষে এ মেলা পায় ভিন্নমাত্রা। বাঙালির আবেগ ও অনুভূতি মিশ্রিত এ মাসে অমর একুশে বইমেলা এক অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। আধুনিক যুগে মাতৃভাষা প্রয়োগে ইংরেজি ভাষার মিশ্রণ তীব্র আকার ধারণ করেছে।
সুশীল সমাজ থেকে ভাষা প্রয়োগে যেসব অনিয়ম রয়েছে, সেগুলো নিয়ে প্রায়ই কথা বলতে শোনা যায় ভাষার মাসেই। লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের কাছে বইমেলা হলো সেরা উৎসব। ভাষা আন্দোলনের গৌরবের ইতিহাসকে অম্লান করে রাখতেই বইমেলার নামকরণ করা হয়েছে অমর একুশে বইমেলা। এবারের বইমেলার মূল প্রতিপাদ্য- ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান : নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ।’ মেলার রং হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে লাল, কালো ও সাদা।
বিপ্লবের প্রতীক হিসেবে লাল, শোকের প্রতীক হিসেবে কালো এবং আশার প্রদীপ হিসেবে চিরকালীন সাদা। এবারের বইমেলায় অংশগ্রহণ করেছে মোট ৭৮০টি প্রকাশনা। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ৯৯টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৬০৯টি, মোট ইউনিট ১০৮৪টি।
দেশের নানা পরিবর্তনশীল অবস্থা সত্ত্বেও শীত ও বসন্তের সন্ধিক্ষণে ফেব্রুয়ারির এক তারিখ থেকেই শুরু হয়েছে অমর একুশে বইমেলা ২০২৫। বরাবরের মতো এবারও বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রাঙ্গণজুড়ে সাজানো হয়েছে নানা বইয়ের পসরা। অংশগ্রহণ করেছেন দেশের খ্যাতনামা প্রকাশনা সংস্থাগুলো।
গত সপ্তাহে বইমেলা শুরু হওয়ার প্রথম প্রহরে গিয়ে দেখলাম নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় বইপ্রেমীরা আসছেন ক্রমাগত। সময় যত গড়িয়ে যাচ্ছে ফাঁকা জায়গাগুলো ভরে যাচ্ছে, মানুষের পদচারণায়। তরুণীরা মাথায় ফুল দিয়ে যেভাবে ঘুরে বেড়ায়, তা বইমেলার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিচ্ছে অনেকখানি।
মেলায় ঢুকে প্রথম স্টলেই চোখে পড়ল প্রধান উপদেষ্টার বাল্যকাল থেকে নোবেলজয়সহ বর্ণাঢ্য এক জীবনের নানা অধ্যায় নিয়ে রচিত বই। এছাড়াও পুরনো লেখকদের পাশাপাশি নতুন লেখকদেরও অনেক বই দেখলাম। কথা প্রসঙ্গে একজন প্রকাশক জানালেন, দেশের ভিন্ন প্রেক্ষাপট সত্ত্বেও বেড়েছে বই প্রকাশের সংখ্যা। মেলায় আগতদের মধ্যে ক্রেতার সংখ্যা কম হলেও তিনি বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। কেননা, প্রযুক্তির এই যুগে সব বয়সী মানুষ মেলায় এসে ঘুরে ঘুরে বই দেখছে, অনুধাবন করছে। তিনি আশা প্রকাশ করলেন, এভাবেই তরুণ-তরুণীরা হবে বইমুখী।
বাংলাদেশে বছরজুড়ে অনুষ্ঠিত হয় নানা মেলা। প্রতিটি মেলাই বহন করে ভিন্ন ভিন্ন গুরুত্ব। তবে অমর একুশে বইমেলার ভিত্তি হলো বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। এবার বইমেলার আয়োজনকে জিরো ওয়েস্ট বইমেলায় পরিণত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এই লক্ষ্যে আয়োজনস্থল ও পার্শ্ববর্তী এলাকার সকল স্টল, দোকান, মঞ্চ, ব্যানার, লিফলেট, প্রচারপত্র, ফাস্টফুড, কফিশপ এবং খাবারের দোকানে পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার প্রায় শতভাগ পরিহার করে পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং পরিবেশবান্ধব উপকরণ- যেমন পাট, কাপড়, কাগজ ইত্যাদি ব্যবহার করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে আহ্বান জানানো হয়েছে। দেশের অর্থনীতিতে এ মেলার অবদান ছোট করে দেখার অবকাশ নেই।
বইমেলা উপলক্ষে আর্থিক লেনদেনও বাড়ে নানাভাবে। অর্থনীতিতে যোগ হয় বাড়তি টাকা। দৈনিক পত্রিকা থেকে শুরু করে অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং বইমেলাকেন্দ্রিক বুলেটিনে ছাপা হয় কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপন। লেখক-প্রকাশক উভয়পক্ষই দিয়ে থাকেন এ বিজ্ঞাপন। এতে বইয়ের খবর পৌঁছে যায় সাধারণ মানুষের মধ্যে।
আবার মেলাকে ঘিরে কয়েক মাস আগে থেকেই বই ছাপার কাজ শুরু হয় বাংলাবাজার, নীলক্ষেত, কাঁটাবন, আরামবাগসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ছাপাখানাগুলোয়। মেলার শুরু হওয়ার দুই মাস আগে থেকেই কম্পোজ, প্রুফ, পেস্টিং, প্লেট, ফাইনাল শব্দে মুখরিত বইয়ের কারিগররা দিন-রাত পরিশ্রম করেন প্রতিটি ছাপাখানায়। অন্যান্য মাসের চেয়ে শ্রমিকরাও নিয়মিত বেতনের চেয়েও বাড়তি আয় করেন। কাজের অতিরিক্ত চাপ থাকায় এ সময় এখানে খ-কালীন চাকরিরও সুযোগ হয়। ছাপা, বাঁধাই ও নান্দনিক মোড়ক লাগানোর পর কর্মচারীর হাত থেকেই বই চলে যায় অমর একুশে গ্রন্থমেলায়।
বইমেলায় প্রকাশিত অবিক্রীত বইগুলো পরবর্তীকালে চলে যায় পুরনো বইয়ের দোকানে। ঢাকার পল্টন, মিরপুর, নীলক্ষেত এলাকায় পুরনো বইয়ের ব্যবসা থাকে সরগরম সারাবছরই। তাছাড়া প্রতিবছরই বাড়ছে বই বিক্রি। সেই সঙ্গে বাড়ছে বই বিক্রি থেকে প্রাপ্ত আয়ও।
অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ২০২৪ সালে ৬০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে ৩ হাজার ৭৫১টি নতুন বই। ২০২৩ সালে বিক্রি হয়েছিল ৪৭ কোটি টাকার বেশি বই আর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৭৩০টি। ২০২২ সালে বিক্রি হয়েছিল ৫২ কোটি টাকার বই।
উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি চত্বরে অমর একুশের গ্রন্থমেলা শুরু হয় আড়ম্বরপূর্ণভাবে। সেই থেকে আজ অবধি মাসজুড়ে চলে বইমেলা। টানা এক মাস বইমেলা বিশ্বের আর কোনো দেশে হয় না। বর্তমানে একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে দেশের প্রকাশনা শিল্প। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লেখকরা তাদের লেখনী প্রকাশ করতে খুঁজে পেয়েছে প্ল্যাটফর্ম।
টানা এক মাসের বইমেলা পরিণত হয় কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী ও পাঠকদের মিলনমেলায়। নদীর স্রোতের মতো আপন গতিতেই এগিয়ে চলেছে বইমেলা। দিন দিন বাড়ছে পাঠকের সংখ্যা। বর্তমানে ভাষার মাসে ঢাকার অমর একুশে বইমেলার হাত ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ফেব্রুয়ারি মাসে আয়োজন করা হয় বইমেলার। এখন চলছে বইমেলার শেষ প্রহর।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে ইচ্ছা করলেই হাতের মুঠায় মোবাইলের মাধ্যমে যে কোনো বই পাঠক সহজেই পেয়ে যায়। তবে বইয়ের পাতা উল্টিয়ে পড়ার আনন্দ বইপ্রেমীদের জন্য নিয়ে আসে ভিন্ন আবেদন। এ কারণেই বইয়ের প্রতি ভালোলাগা চির অম্লান। এই সহজ সমীকরণ মিলে যাবে বিক্রির সূচকের দিকে তাকালেই। বই হোক বিনোদন ও সৃজনশীল সৃষ্টির অন্যতম মাধ্যম।
প্রযুক্তির অভাবনীয় উদ্বোধনের ফলে অনেক প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেলেও ফুরায়নি বইয়ের প্রতি পাঠকের প্রেম। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক কবি-লেখক বহুকাল আগে প্রয়াণ করা সত্ত্বেও এখনো আমরা খুঁজে পাই তাঁদের বইয়ের পাতায়। লেখনীর মাধ্যমে লেখকরা বেঁচে থাকেন যুগ যুগ ধরে।
বর্তমান যুবসমাজকে বইয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে বইমেলা যেমন গুরুত্ব বহন করে, তেমনি লেখকদেরও সচেতনতার সঙ্গে সৃজনশীলতার বহির্প্রকাশ ঘটাতে হবে। বর্তমানে সামর্থ্য থাকলেই যে কোনো মানুষই বই লিখতে পারেন। পাঠক ও লেখকের মেলবন্ধন অমর একুশে বইমেলা থাকুক চির অম্লান- এই প্রত্যাশা।
লেখক : সাংবাদিক