
সম্পাদকীয়
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় এক অভিন্ন সমস্যা বাজার অস্থিরতা। বাংলাদেশের মতো অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী শ্রেণির সরব উপস্থিতি যেখানে আছে, সেখানে জ্বালানি তেলের দাম লিটারে এক/দু’টাকা বাড়লে তো কথাই নেই- খাদ্যদ্রব্যের মতো নিত্যপণ্যের দাম কেজিতে পাঁচ/দশ টাকা বৃদ্ধি পায়। এমন এক অনিয়ন্ত্রিত, অস্থির বাজার ব্যবস্থাপনায় ভোক্তা সাধারণের জীবন মান হাঁসফাঁস করে।
দেশের আমজনতার দৈনন্দিন জীবনে টেকসই স্বস্তি প্রতিষ্ঠায় চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদের বহুল কার্যক্রম দেখা যায়। বাংলাদেশে সে তুলনায় খুব কম। সাম্প্রতিককালে দেশে আধুনিক শহুরে জীবনে সুপারশপ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম জনবহুল এ দেশের সীমিত ভৌগোলিক সীমায় প্রতি ইঞ্চি ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহার সুনিশ্চিত করা গেলে আগামী দিনে আর কখনো খাদ্য সংকট দেখা দেবে না। বরং আমরা নিজেদের চাহিদা নিবারণ করে বিদেশে খাদ্য পণ্য রপ্তানি করতে পারব। বৈদেশিক মুদ্রা আসবে, দেশের জনগণ স্বল্পমূল্যে খাদ্যপণ্য কিনতে পারবে।
রাষ্টীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদকে উৎসাহ দেওয়া এখন সময়ের দাবি। উন্নত বাজারজাত কৌশল প্রণয়ন এবং কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প বিকাশের মাধ্যমে অধিক হারে চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ করা গেলে বাজারে টেকসই স্থিতিশীলতা আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞগণ। এজন্য রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের এমন কৌশল প্রণয়ন করতে হবে, যার মাধ্যমে চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদের যৌক্তিক উপযোগিতা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
সম্প্রতি রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইন মিলনায়তনে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর ৮ম বার্ষিক সম্মেলনে বক্তারা চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, অধিক হারে এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ হলে বাজারে স্থিতিশীলতা আসতে পারে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, বাংলাদেশে ৫০ শতাংশের বেশি কৃষক তাদের জমিতে শুধু চাল উৎপাদন করেন। কারণ, অনুসন্ধানে জানা যায়, আমাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে চাল হলো সবচেয়ে স্থিতিশীল পণ্য।
দেশের গরিব কৃষক সমাজ নিজেদের পরিবারের বাৎসরিক খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য ধান উৎপাদন করে থাকে। তাদের কাছে বাজারে বিক্রির মতো উদ্বৃত্ত চাল সাধারণত থাকে না। ফলে, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে দেশীয় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে অধিক হারে চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদের পদক্ষেপ নিতে হবে আগামীর বাংলাদেশের নাগরিকদের খাদ্য নিরাপত্তাকল্পে।
দেশে উৎপাদিত শস্যের মধ্যে গমের মূল্য সবচেয়ে কম, এরপর চাল। গত ১০ বছরের তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, চালের দামে তারতম্য হয়েছে। পক্ষান্তরে টমেটো, মরিচ, লেবু, শসা, গাজরসহ অন্য শস্যমূল্যের তারতম্য ছিল অনেক বেশি।
যদি কৃষককুল উচ্চমূল্যের কৃষিপণ্য বেশি উৎপাদন করত, তবে এসবের দাম কমে আসত। উচ্চমূল্যের শস্য কৃষকরা খুব বেশি উৎপাদন করে না। চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ সংস্কৃতির বিস্তারে কৃষি প্রযুক্তির আধুনিকায়ন ও উচ্চমূল্যের শস্য উৎপাদনে সরকারকে জোর দিতে হবে। কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে আমরা দারিদ্র্যকে বিদায় জানাতে পারি। সম্ভবনাময় শিক্ষিত তরুণ সমাজকে কৃষিকাজে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
গ্রামাঞ্চলে সাধারণত দরিদ্র ও ভূমিহীন মানুষই কৃষি কাজ করেন। প্রয়োজনে তাদের প্রণোদনা দিতে হবে। ধানের পাশাপাশি উচ্চমূল্যের কৃষিপণ্য উৎপাদনে চুক্তিভিত্তিক আধুনিক প্রযুক্তি কর্মসংস্থান তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।