
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা গত কয়েক দশকে বিশাল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেলেও, উচ্চশিক্ষার প্রসার ও কর্মসংস্থানের মধ্যে প্রয়োজনীয় সমন্বয় তৈরি হয়নি। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ যেমন বেড়েছে, তেমনি শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও বেড়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মে ২০২৪ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশে বর্তমান বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য এক উদ্বেগজনক বিষয়।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আশানুরূপ হারে বেড়েছে। তবে শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে সে উন্নতি পরিলক্ষিত হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীরা দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। যার ফলে চাকরির বাজারে টিকে থাকা তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৩টি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রায় ১১৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।
তবে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও মানসম্মত শিক্ষকের অভাব রয়েছে। ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্টস কমিশন (ইউজিসি) বারবার মানোন্নয়নের তাগিদ দিলেও, বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি শিক্ষার মান নিয়েও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার ক্ষেত্রে তেমন গুরুত্ব দেয় না অথচ গবেষণা উচ্চশিক্ষার অন্যতম প্রধান ভিত্তি। ফলে আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়েও বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় উল্লেখযোগ্য অবস্থানে নেই।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা মূলত তাত্ত্বিক জ্ঞান প্রদানেই বেশি মনোযোগী, যেখানে ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জনের সুযোগ খুবই কম। বর্তমান বিশ্বে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে তথ্যপ্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডেটা সায়েন্স ও ব্লকচেইনের মতো ক্ষেত্রে দক্ষ জনবল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অথচ বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী এখনো ঐতিহ্যবাহী বিষয়ে পড়াশোনা করছে যেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ তুলনামূলকভাবে কম।
বিগত বছরগুলোতে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কিছু উন্নতি দেখা গেলেও, দক্ষ জনবলের অভাবে এ খাত তার পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারছে না। অন্যদিকে স্বাস্থ্যসেবা, ইঞ্জিনিয়ারিং (প্রযুক্তি ও কারিগরি সেক্টর), কৃষি, মৎস্য এবং আইন অঙ্গনে দক্ষ জনবলের অভাব দিন দিন বাড়ছে।
দক্ষ জনবলের এত অভাবের পরও দেশে লাখ লাখ বেকার রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (ILO) মতে, দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যার একটি বড় অংশ কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না।
বিশেষত, মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান (সোশ্যাল সায়েন্স) থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের বেকারত্বের হার তুলনামূলকভাবে বেশি। অন্যদিকে প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রচুর চাহিদা থাকলেও শিক্ষার্থীরা সেই সুযোগ যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারছে না।
এ বিশাল বেকারত্ব সৃষ্টির মূল কারণ হিসেবে অপরিকল্পিত উচ্চশিক্ষাইকে দায়ী করা যায়। যদি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে যথাযথ পরিকল্পনার আওতায় আনা যায়, তাহলে বেকারত্ব অনেকাংশে হ্রাস পাবে। এজন্য প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। দেশ ও বিদেশের জনশক্তির চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উচ্চশিক্ষার পরিকল্পনা করতে হবে।
অপরিকল্পিত উচ্চশিক্ষা শুধু বেকারত্বই বাড়াচ্ছে না, বরং সময়, মেধা ও অর্থের অপচয় ঘটাচ্ছে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময়োপযোগী শিক্ষানীতি ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।
পরিকল্পিত ও মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করা গেলে বেকারত্ব দূর হবে এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে।
শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
কুতুবে রব্বানী