
মানবসভ্যতার ইতিহাসে বারবার যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে প্রযুক্তির হাত ধরে। তবে বর্তমান সময়ের পরিবর্তন যেন অতীতের সব বিপ্লবকে হার মানিয়ে সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে পুরো পৃথিবীর সামনে। বিজ্ঞানের ঈর্ষণীয় সাফল্যের নতুন উদ্ভাবন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শুধু প্রযুক্তির অগ্রগতি নয়, বরং অর্থনীতি, সমাজ ও শ্রমবাজারের জন্য এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিয়েছে। একদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের জীবনকে সহজ, সুন্দর ও সাবলীল করছে স্বয়ংক্রিয় কারখানা, স্মার্ট ব্যাংকিং, ডাক্তারবিহীন রোগ নির্ণয়ের মতো যুগান্তকারী ও কল্যাণকর আবিষ্কারের মাধ্যমে। অন্যদিকে এটাই মানুষের চাকরি কেড়ে নিচ্ছে কিংবা কিছু ক্ষেত্রে চাকরি হ্রাসের কারণ হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এটি একদিকে চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে নতুন সম্ভাবনার দুয়ারও খুলে দিতে পারে।
বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থান কর্মসংস্থানের চিত্রকে আমূল বদলে দিচ্ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে ,২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মানুষ কর্মসংস্থান হারাতে পারে। কারণ তাদের কাজগুলো স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় প্রতিস্থাপিত হবে। স্বল্প দক্ষতা ও মধ্যম স্তরের চাকরিগুলোর ওপর পরবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব। উৎপাদন, বিপণন, গ্রাহকসেবা, এমনকি সাংবাদিকতা, আইন ও চিকিৎসার মতো পেশাগুলোতেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব এখনই পরীক্ষামূলকভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে। ভবিষ্যতে এর মাত্রা আরও বাড়বে। বাংলাদেশেও এই প্রভাব স্পষ্ট। গার্মেন্টস শিল্পে ঈঅউ/ঈঅগ সফটওয়্যার ও অটোমেশন ২০২২-২৩ সালে ১২% চাকরি কমিয়েছে (সূত্র : বাংলাদেশ ব্যাংক)। বিশ্বব্যাংক, অক্সফোর্ড ইকোনমিকস ও ম্যাকিন্সে গেøাবাল ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, এশিয়ার শ্রমবাজার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত, ফিলিপিন, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোতে যেখানে শ্রমের ওপর ভিত্তি করে শিল্পবিপ্লব গড়ে উঠেছে, সেখানে এআই-নির্ভর অটোমেশন এক নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডঊঋ) মতে, আগামী পাঁচ বছরে প্রায় ৮৩ মিলিয়ন চাকরি হারিয়ে যাবে। একই সঙ্গে ৬৯ মিলিয়ন নতুন চাকরির সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ নতুন দক্ষতার চাহিদা তৈরি হবে, কিন্তু প্রচলিত অনেক চাকরি হারিয়ে যাবে। বাংলাদেশের শ্রমবাজার মূলত গার্মেন্টস, কৃষি, নির্মাণ এবং পরিষেবা খাতের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের তৈরি পোশাকশিল্প প্রায় ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের জোগান দেয়। যার মধ্যে ৮০ শতাংশই নারী শ্রমিক। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা চালু হলে অনেক শ্রমিকের কাজ হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।
গেøাবাল কনসালটিং ফার্ম চঈি-এর গবেষণা বলছে, আগামী দুই দশকের মধ্যে বাংলাদেশের মোট কর্মসংস্থানের ২০-৩০ শতাংশ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অটোমেশনের কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। বিশেষ করে গার্মেন্টস, কলসেন্টার, ডাটা এন্ট্রি, ব্যাংকিং, অ্যাকাউন্টিং, গ্রাহক সেবা এসব খাতে মানুষের পরিবর্তে সফটওয়্যার ও রোবট ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। তবে এআই-র অর্থনৈতিক সুবিধা অস্বীকার করার উপায় নেই। ২০২৩ সালে ১.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ২০৩০ সাল নাগাদ বার্ষিক ৪.৪ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। এআই চালিত ডায়াগনস্টিক টুলস ব্যবহার করে বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে ৪০ শতাংশ অপচয় রোধ হচ্ছে। শুধু তাই নয় এআই কৃষি ক্ষেত্রেও বিপ্লব এনেছে।‘অও ভধৎসবৎ’ অ্যাপের মাধ্যমে ২ লাখ কৃষকের ফসলের উৎপাদন ৩০ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু এই সুবিধার ছায়ায় লুকিয়ে আছে বেকারত্বের বিষাদ। বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশের ৬৭ শতাংশ কর্মী এআই-সামর্থ্য সমন্বিত চাকরির জন্য প্রস্তুত নয়। কেননা বাংলাদেশে ডিজিটালাইজেশনের প্রসার ঘটলেও এখনো দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতি প্রকট। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো প্রচলিত সিলেবাসের মধ্যে আবদ্ধ, যেখানে মেশিন লার্নিং, ডাটা সায়েন্স, রোবোটিকস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মতো বিষয়গুলো পর্যাপ্ত গুরুত্ব পাচ্ছে না। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম শুরু হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতগুলো। কেননা দেশের ৮৫ শতাংশ কর্মী এ খাতে নিয়োজিত, যেখানে অটোমেশন দ্রæত ছড়ালে সামাজিক সংকট তৈরি হবে। তাই চাকরির বাজার রূপান্তরের সঙ্গে তাল মেলাতে শিক্ষাব্যবস্থায় জরুরি পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এআই, রোবটিকস, ক্লাউড কম্পিউটিং, সাইবার সিকিউরিটির মতো স্কিল ডেভেলপমেন্টে গুরুত্ব বাড়াতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কর্মীদের নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করতে হবে। বিশেষত নারীদের এআই-চালিত সোলার গ্রিড ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণের মতো এমন প্রকল্পের উদ্যোগ বাড়াতে হবে। শিল্প খাতের সঙ্গে সমন্বিত টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে হবে। প্রযুক্তিনির্ভর স্টার্টআপ ও উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ নীতিগত সহায়তা দিতে হবে। প্রযুক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়িয়ে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সুযোগ তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশে এআই গবেষণার জন্য সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
পাশাপাশি কিছু নীতিনির্ধারণী পদক্ষেপ এবং নীতিমালার সংস্কার প্রয়োজন। এআই-এর অপব্যবহার রোধ ও ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপ জরুরি। কর্মী সুরক্ষা, নৈতিক এআই চর্চা, সামাজিক নিরাপত্তার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। দেশে এআই ও অটোমেশন সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরি করতে হবে, যাতে মানবশ্রমের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব রক্ষা করা যায় এবং একটি ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। অটোমেশন প্রবর্তনের আগে শ্রমিকদের পুনর্বাসন নীতি বাধ্যতামূলক করা জরুরি। বেসিক ইনকাম বা কর্মসংস্থান ভাতার মতো প্রকল্প প্রসারিত করতে হবে। সর্বোপরি ডাটা প্রাইভেসি ও অ্যালগরিদমিক পক্ষপাতিত্ব নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এআইকে ভিলেন না ভেবে একে মানবসম্পদ উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে দেখা জরুরি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কোনো বিকল্প নয়, এটি একটি বাস্তবতা যা মানব সভ্যতার গতি নির্ধারণ করবে। বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো প্রযুক্তির গতির সঙ্গে সামাজিক সুরক্ষার সমন্বয় করা। শিক্ষা, নীতি ও উদ্ভাবন এই তিন স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে এগোতে পারলেই এআই হবে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি, বেকারত্ব নয়। বাংলাদেশ যদি এখনই যথাযথ উদ্যোগ নেয়, দক্ষতা উন্নয়ন ও নীতিনির্ধারণে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়, তবে এআই বিপ্লব আমাদের জন্য এক আশীর্বাদ হয়ে উঠতে চলেছে। কিন্তু যদি আমরা পিছিয়ে পরি, তাহলে আগামী দশকে চাকরিহীনতার বড় ঢেউ আমাদের অর্থনীতিকে নড়বড়ে করে দিতে পারে। সময় এখনই প্রস্তুতি নেওয়ার নিজেদের দক্ষ করে তোলার। এআইকে ভবিষ্যতের জন্য আশীর্বাদ করে তুলতে প্রস্তুতির কোনো বিকল্প নেই।
শিক্ষার্থী, ইডেন মহিলা কলেজ