
ছবিঃ সালমান আমীন
মহান আল্লাহ বলেন—“ঐ ব্যক্তির চেয়ে উত্তম আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সৎকর্ম করে এবং বলে, ‘আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত’?” (সূরা হা-মীম সাজদা: ৩৩)। মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করা নিঃসন্দেহে একটি মহৎ কাজ। মহান রব্বুল আলামীন মানবজাতির হেদায়েতের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসুলকে প্রেরণ করেছেন। নবুওতের ধারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মাধ্যমে সমাপ্ত হলেও ইসলামের দাওয়াত কিয়ামত পর্যন্ত চলবে। এই দায়িত্ব সামগ্রিকভাবে সকল মুসলমানের হলেও নবী-রাসুলদের উত্তরসূরি হিসেবে আলেম-ওলামাদের ওপর এটি বিশেষভাবে অর্পিত হয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণ থেকে শুরু করে যুগে যুগে আলেমগণ ইসলাম প্রচারের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তাদের মহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে ইসলামের সুমহান বানী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তরে পৌছানো সম্ভব হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ওয়াজ মাহফিল
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের অন্যতম মাধ্যম হলো ওয়াজ মাহফিল। শত শত বছর ধরে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত সাধারণ মানুষ এসব মাহফিলে অংশ নিয়ে ইসলামের মৌলিক শিক্ষাগুলো জানতে পেরেছে এবং আমলের অনুপ্রেরণা লাভ করেছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি বড় মাধ্যম, যার মাধ্যমে অসংখ্য মানুষ সঠিক পথে আসতে পারে।
আধুনিক সময়ে ওয়াজ মাহফিলের চ্যালেঞ্জ
বর্তমানে ওয়াজ মাহফিলের সংখ্যা বেড়েছে, তবে কিছু ক্ষেত্রে গুণগত মান ও মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য—
❋ অতিরিক্ত শব্দদূষণ: দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ শব্দে মাইক বাজানোর ফলে শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থদের কষ্ট হয় এবং শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটে।
❋ স্থান নির্বাচন: ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ওয়াজ মাহফিল আয়োজন আশপাশের মানুষের জন্য বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে।
❋ সঠিক ইসলামী জ্ঞানের ঘাটতি: অনেক বক্তা পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন না করেই ওয়াজ করে থাকেন, ফলে বিভ্রান্তি ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে।
❋ রাত জাগরণ: দীর্ঘ রাত পর্যন্ত ওয়াজ-মাহফিল চললে সাধারণ মানুষের জন্য তা বিড়ম্বনার কারণ হয়।
❋ শ্রোতার অভাব: কিছু মাহফিলে সঠিক প্রচার ও গুণগত মানের অভাবে শ্রোতা কম থাকে, ফলে দাওয়াতি কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়।
ওয়াজ মাহফিলকে আরও ফলপ্রসূ করার উপায়
❋ উপযুক্ত স্থান নির্বাচন: জনবহুল এলাকা এড়িয়ে অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি জায়গায় মাহফিল আয়োজন করা উচিত, যাতে শব্দদূষণ কম হয়।
❋ শব্দের সীমাবদ্ধতা: মাইকের আওয়াজ মাহফিলের প্যান্ডেলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত, যাতে আশেপাশের মানুষের কষ্ট না হয়।
❋ অতিরিক্ত রাত জাগরণ পরিহার: ওয়াজ মাহফিল রাতের মধ্যভাগ পর্যন্ত না চালিয়ে দিনের বেলা বা রাতের প্রথম ভাগে শেষ করা উচিত।
❋ বিশুদ্ধ ইসলামী জ্ঞান প্রচার: বক্তাদের অবশ্যই যথাযথ জ্ঞান অর্জন করে কুরআন ও হাদিসের আলোকে সঠিক তথ্য প্রচার করা উচিত, যেন ইসলাম নিয়ে বিভ্রান্তি না ছড়ায়।
❋ নিয়ত বিশুদ্ধ রাখা: ওয়াজ মাহফিলের উদ্দেশ্য হতে হবে মানুষের হেদায়েত ও আল্লাহর সন্তুষ্টি, ব্যক্তিগত খ্যাতি বা আর্থিক স্বার্থ নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—
" মি’রাজের রাতে আমি দেখলাম, কিছু লোকের ঠোঁট আগুনের কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছে। জিবরাইল (আ.) বললেন, এরা আপনার উম্মতের সেই বক্তাগণ, যারা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করত, কিন্তু নিজেরা তা আমল করত না।" (আহমাদ)
❋ আর্থিক স্বচ্ছতা: ওয়াজ মাহফিলের জন্য অনুদান গ্রহণ করা যেতে পারে, তবে তা যেন স্বচ্ছভাবে হয় এবং বিতর্কিত না হয়।
ওয়াজ মাহফিল ইসলামের দাওয়াতি কার্যক্রমের অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম। তবে এটি যেন সঠিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়, যাতে মানুষের জন্য কল্যাণকর হয় এবং ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরে। আলেম-ওলামাদের উচিত মাহফিলের মানোন্নয়নে আরও যত্নশীল হওয়া, যাতে এটি সত্যিকারের হেদায়েতের মাধ্যম হয়ে ওঠে। মহান রব্বুল আলামীন আমাদেরকে ইসলামের সুমহান বানী বুঝার, আমল করার এবং সঠিকভাবে পৌঁছানোর তাওফিক দান করুন। আমীন।
মুহাম্মদ ওমর ফারুক