
ছবি : সংগৃহীত
ভাষা একটি দেশের স্বকীয়তা ফুটিয়ে তোলে। দেশের নিজস্বতার বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করে ভাষা। বিভিন্ন দেশের সাধারণ মানুষ নিজেদের ভাব মাতৃভাষার মাধ্যমেই বিনিময় করে। ভাষা কোনো দেশের সংস্কৃতি, আবহ, কৃষ্টি বৈচিত্র্যময়তা তুলে ধরে। এতে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ভাষার গুরুত্ব ও মাধুর্য সহজে প্রকাশ পায়। একটি দেশ তত বেশি বিকশিত যত বেশি দেশটির ভাষা পরিশীলিত ও সহজে প্রকাশযোগ্য। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা তেমনি ইতিবাচক ও সর্বমহলে গ্রহণীয়।
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। আমাদের প্রাণের ভাষা। এই ভাষা বড্ড শ্রুতিমধুর ও রুচিসম্মত। আমরা আমাদের মনের ভাব আদান প্রদান করে থাকি বাংলা ভাষার মাধ্যমে। যার ফলে বাঙালির ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বাংলাভাষাকে গণ্য করা হয়। দৈনন্দিন জীবনে আমরা আমাদের নিত্যদিনকার চলাফেরায় বাংলা ভাষার ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। এ ভাষার সহজ সরল ব্যবহার বাঙালিদের মাঝে করে তুলেছে অনন্য। দিন দিন বাংলা ভাষার ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে। মাতৃভাষার সংখ্যায় বাংলা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের পঞ্চম ও মোট ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনুসারে বাংলা বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা। এতে বাংলাভাষার গঠনগত চর্চা ছড়িয়ে যাচ্ছে সকলের মধ্যে। বাংলা ভাষা আমাদের প্রধানতম ভাষা ছাড়াও আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, মিজোরাম, ত্রিপুরা, জলপাইগুড়িসহ আরও কিছু রাজ্যে এই ভাষার ব্যবহার বেশ লক্ষণীয়।
বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা হলেও এ ভাষা অর্জন করা বাঙালির জন্য সুখকর ছিল না। বরং বাংলা ভাষা অর্জনের পথ বাঙালির জন্য অমসৃণ ও কণ্টাকীর্ণ ছিল। বাংলা ভাষা বিকাশের ইতিহাস ১৩০০ বছর পুরনো। চর্যাপদ এ ভাষার আদি নিদর্শন। অষ্টম শতক থেকে বাংলায় রচিত সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডারের মধ্য দিয়ে অষ্টাদশ শতকের শেষে এসে বাংলা ভাষা তার বর্তমান রূপ পরিগ্রহণ করেছে। বাংলা ভাষার লিপি হলো বাংলা লিপি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরে জন্ম হয় ভারত ও পাকিস্তান নামে নতুন দুটি দেশ। পাকিস্তান অংশের দুইটি অংশ ছিল। একটি হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান। অপরটি হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তান অঞ্চলের প্রধান ভাষা ছিল উর্দু ভাষা। আর পূর্ব পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষ বাংলা ভাষা ব্যবহার করত। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান কখনোই তা মেনে নিতে চায় নি। তারা সবসময় উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান ও দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আসছিল। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের কয়েক মাসের মধ্যেই পাকিস্তানের প্রথম মুদ্রা, ডাকটিকিট, ট্রেনের টিকিট, পোস্টকার্ড ইত্যাদি থেকে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দু ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়। পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের এই ঘোষণায় পর ঢাকায় ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাংলাভাষীরা উর্দুভাষীদের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। তারপরও ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এক সমাবেশে স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন যে ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা’। যা এক প্রকার বির্তক ও সমালোচনা সৃষ্টি করে পূর্ব পাকিস্তানে। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগন কখনোই পশ্চিম পাকিস্তানের এই কথা মেনে নেননি। উপরন্তু প্রতিবাদ ও আন্দোলনে মুখর থাকেন পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ।
সেই আন্দোলন ও প্রতিবাদের ফসল হচ্ছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে সালাম, রফিক, শফিক, জব্বার প্রমুখদের তাজা রক্তে ইতিহাস রচিত হয় এই ভূখণ্ডে। তাদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা অর্জন করি আমাদের মায়ের ভাষার স্বীকৃতি। যে স্বীকৃতির বলীয়ানে বাঙালিরা খুঁজে পায় আলোর দিশা। পশ্চিম পাকিস্তানিরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জোরপূর্বক অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল উর্দু ভাষা। কিন্ত সালাম, রফিক, শফিক, জব্বারদের ত্যাগ তিতিক্ষা ও সংগ্রামে তা সম্ভব হয়নি এই বদ্বীপে। ঐতিহাসিকভাবে এই ইতিহাস, আন্দোলন প্রতিটি বাঙালির নিকট স্মৃতিতে অমলিন ও চিরভাস্বর হয়ে আছে। তাদের অকুণ্ঠ অবদান বাঙালি জাতির ইতিহাসকে করেছে গৌরবোজ্জ্বল।
শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের মাতৃভাষা। কিন্তু যে ভাষার জন্য দেশের মানুষের এত আত্মত্যাগ, নিবেদন, সে ভাষার ব্যবহার ও বিকাশ প্রকৃতপক্ষে সেভাবে হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে অফিস, আদালত, আমলাতান্ত্রিক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সকল প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষার ব্যবহার সেরূপ হচ্ছে না। তা ছাড়া আমরা পাশ্চাত্যের মোহে আকৃষ্ট হওয়ার ফলে ক্রমেই ইংরেজি ভাষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। অনেকেই ইংরেজি ভাষাকে অধিক প্রাধান্য দিচ্ছি বাংলা ভাষার তুলনায়, যা বাংলা ভাষাকে হুমকির মুখে ফেলছে এবং বাংলা ভাষার শতভাগ বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে। তাছাড়া বাংলা ভাষার নিয়ম কানুন ও অনুশীলনের প্রতিও আমরা যথাযথ যত্নশীল নই।
বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃত একটি ভাষা। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো দেশের মানুষ নিজেদের ভাষার জন্য প্রাণ দেয়নি। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে ঐক্যের বীজ বপন হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের দ্বারা। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। অতঃপর ২০০০ সাল থেকে একযোগে পুরো বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলা ভাষার ব্যবহার, অনুশীলন ও বিকাশ অত্যন্ত জরুরি। সেজন্য উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় বাংলা ভাষাকে বিশেষভাবে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। বাংলা ভাষার নিয়মকানুনের প্রতিও সকলকে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। প্রাক প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত বাংলা ভাষাকে অনুশীলন ও চর্চার আওতায় রাখা প্রয়োজন। বাংলা ভাষা বিষয়ক গবেষণাকর্মও বৃদ্ধি করা চাই। বাংলা ভাষা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করা দরকার। শিক্ষার্থীদের মাঝে বাংলা ভাষায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেতে পারে। এতে শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষা জানার ও শিখার প্রতি আরও আগ্রহী হয়ে উঠবে। শুধু ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রিক আয়োজন না করে বছরব্যাপী বাংলাভাষার আয়োজন ও চর্চা অব্যাহত রাখা আবশ্যক। বাংলা ভাষাকে উচ্চশিক্ষার স্তরে বিস্তৃত পরিসরে ছড়িয়ে দিতে হবে। এতে বাংলা ভাষার লাল সবুজের আবহমান গুরুত্বতা ও কদর আরো গতিশীল হবে বিশ্বপরিমণ্ডলে।