ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১ ফাল্গুন ১৪৩১

নিরাপদ-নির্ঝঞ্ঝাট হোক রমজান

ড. আলা উদ্দিন

প্রকাশিত: ১৯:৪১, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

নিরাপদ-নির্ঝঞ্ঝাট হোক রমজান

মার্চের শুরু থেকেই পবিত্র রমজান শুরু হচ্ছে। সারাদেশের মানুষ একে অনুগ্রহ, শান্তি এবং মর্যাদার সঙ্গে পালন করার আশা রাখে। তবে, কয়েকটি জোরালো উদ্বেগ রমজানের আধ্যাত্মিক এবং সামাজিক দিকগুলোর ওপর ছায়া ফেলছে। দেশের জনগণ অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের আকাশছোঁয়া দাম, অব্যাহত ট্রাফিক জট, অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ঈদে তাদের প্রিয়জনদের সঙ্গে উদ্যাপন করার ক্ষেত্রে পরিবহনসহ অপরাপর চ্যালেঞ্জগুলোর থেকে মুক্তি প্রত্যাশা করে। অন্তর্বর্তী সরকার সমস্যাগুলো সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এখন জনগণ কার্যকর পদক্ষেপের জন্য উদগ্রীবভাবে অপেক্ষা করছে।
রমজানে সবচেয়ে বড় উদ্বেগসমূহের মধ্যে একটি হলো দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি। ঐতিহাসিকভাবে, খেজুর, ডাল, ছোলা, তেল, চিনি এবং মাংসের মতো খাদ্যপণ্যের চাহিদা এই সময়ে বৃদ্ধি পায় অযৌক্তিক কারণে। পৃথিবীর অন্যান্য মুসলিমপ্রধান দেশে রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দাম যথাসম্ভব কম থাকলেও, ব্যতিক্রম কেবল বাংলাদেশে। দুঃখজনকভাবে অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রায়ই পবিত্র মাসের চাহিদাকে অপব্যবহার, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি এবং মূল্য বৃদ্ধি করে। সরকারের মূল্য নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, অনেক গ্রাহক তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনা সম্ভব হয় না বলে মনে করেন। অতীত অভিজ্ঞতা এরই সাক্ষ্য দেয়।
এমতাবস্থায় কর্তৃপক্ষকে বাজার কার্যক্রম মনিটর করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ, মজুতদার এবং অসৎ ব্যবসায়ীদের শাস্তির আওতায় আনা এবং দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ন্যায্যমূল্যের বাজার প্রতিষ্ঠা, সরকারের পরিচালিত ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) প্রোগ্রামের কার্যকারিতা বৃদ্ধি এবং বাজার সরবরাহ বাড়ানোর জন্য উৎসাহিত করলে গ্রাহকদের ওপর চাপ কমাতে সহায়ক হতে পারে।
রমজানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো শহুরে এলাকায়, বিশেষত ঢাকা, চট্টগ্রামসহ প্রধান প্রধান শহরে অসহনীয় ট্রাফিক জ্যাম। ইফতারের নির্দিষ্ট সময় ও পরিবর্তিত অফিস সময়সূচির ফলে সড়কগুলোতে অতিরিক্ত জ্যাম হয়ে যায়। এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষের পরিবারের সঙ্গে ইফতার করতে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য তাড়া থাকে। এ ছাড়া বাণিজ্যিক কার্যক্রমের বৃদ্ধি, ঈদের কেনাকাটা এবং ফুটপাতে রাস্তার দোকানদারদের অবস্থান ট্রাফিক পরিস্থিতি সারাদিন অসহনীয় করে তোলে।
সরকার এবং ট্রাফিক কর্তৃপক্ষকে ট্রাফিক জ্যাম কমানোর জন্য কৌশলগত সমাধান বাস্তবায়ন করতে হবে। কার্যকর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অনুমোদিত নয় এমন বাজার ও দোকানপাট বন্ধ করা এবং অফিস ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জন্য এলাকা ও সময় বিবেচনায় ধীরে ধীরে কাজের সময়সূচি প্রবর্তন করলে জ্যাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সেবা সম্প্রসারণ এবং বিকল্প যাতায়াতের ব্যবস্থা উৎসাহিত করাও পরিস্থিতি আরও কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে সাহায্য করতে পারে।
রমজান হলো আধ্যাত্মিক চিন্তা, প্রার্থনা এবং ভক্তির সময়। মানুষ এটি বিঘ্নহীনভাবে পালন করতে চায়। তবে বিদ্যুৎ বিভ্রাট, শব্দদূষণ এবং নিরাপত্তা সম্পর্কিত উদ্বেগ কখনো কখনো তাদের ধর্মীয় অনুশীলনে শান্তিপূর্ণভাবে যুক্ত হতে বাধা সৃষ্টি করে। মসজিদগুলোকে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা উচিত, যাতে জামাতের নামাজ, তারাবির নামাজ আদায় করা নির্বিঘ্ন হয়। এ ছাড়া স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে উপাসনার স্থান এবং আবাসিক এলাকার কাছাকাছি অপ্রয়োজনীয় শোরগোল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যাতে ধর্মীয় আচরণের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়। স্থানীয় সরকার সংস্থা এবং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যথাযথ সমন্বয় অপরিহার্য যাতে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়।
রমজানে ছিনতাই, চুরি, ডাকাতির মতো অপরাধ উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পায়। অপরাধী গোষ্ঠী প্রায়ই জনবহুল বাজার এবং তুলনামূলকভাবে জনশূন্য স্থানে সুযোগ নিতে থাকে, বেখেয়ালি-অসেচেতন ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে। সাম্প্রতিককালে ছিনতাইয়ের খবর বেড়েছে, এমনকি শিশুরাও ছিনতাইয়ের শিকার হয়; যা নাগরিকদের অস্থির করে তুলেছে। রমজানে যেন এর প্রকোপ বন্ধ করা যায়, সেদিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে পেট্রোলিং বাড়াতে হবে। বাজারসমূহে অতিরিক্ত পুলিশ কর্মী মোতায়েন করতে হবে এবং মোবাইল নজরদারি দল গঠন করতে হবে। তা ছাড়া জনগণকে সতর্ক থাকতে এবং সন্দেহজনক কার্যকলাপ তৎক্ষণাৎ রিপোর্ট করতে উৎসাহিত করা উচিত। অপরাধসংক্রান্ত বিষয়গুলোর জন্য একটি জরুরি হটলাইন প্রতিষ্ঠাও কার্যকরি পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করতে পারে।
এ সময়ে কোটি কোটি মানুষ তাদের পরিবারসহ ঈদ উদ্যাপনের জন্য নিজ এলাকায় (বিশেষত গ্রামে) ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। তবে, বাড়ি ফিরে যাওয়া ক্রমাগতভাবে কঠিন হয়ে উঠেছে অতিরিক্ত পরিবহন ভাড়া, টিকিট স্যালপিং এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাবের কারণে। বাস কর্তৃপক্ষ এবং পরিবহন কোম্পানিগুলো প্রায়ই যাত্রীদের অতিরিক্ত ভাড়া নেয়, তাদের প্রিয়জনদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার তাড়াহুড়ার সুযোগ নিয়ে। কালোবাজারে টিকিট বিক্রির ফলে অনেকের জন্য সঠিক দামে ট্রেনের টিকিট পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। রাস্তায় অবিবেচনাপূর্বক চালানোর কারণে সড়ক দুর্ঘটনাও এ সময়ে একটি বড় উদ্বেগ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরকারকে পরিবহন ভাড়া কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তাদের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। টিকিট বিক্রি, সরবরাহ এবং ট্রেন ও বাসের টিকিটের কালোবাজার বিক্রি প্রতিরোধে অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তা ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হাইওয়ে পেট্রোল ইউনিটগুলো শক্তিশালী এবং দীর্ঘপথে যাত্রার আগে যানবাহন ফিটনেস পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
প্রতি বছর ঈদযাত্রার সময়ে দুঃখজনক ঘটনা ঘটে, যার ফলে অপ্রয়োজনীয় প্রাণহানি হয়। অতিরিক্ত ভারি, অবিবেচনাপূর্ণ ড্রাইভিং এবং খারাপ রাস্তার পরিস্থিতি দুর্ঘটনা সৃষ্টি করে, যা সরকারের কার্যকর হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে যে, বাস-ট্রাক যাতে ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে না যায়, সড়কসমূহ সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ এবং ট্রাফিক বিধি কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়। ঈদের আগের দিন, ঈদের দিন ও পরবর্তী দিন সড়ক যখন মোটামুটি জ্যামমুক্ত থাকে, তখন গতি নিয়ন্ত্রণ অত্যাবশ্যক। এ সময়ে অনেক প্রাণহানি ঘটে। অতিরিক্ত ভিড়যুক্ত পরিবহন হাবগুলোতে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। জরুরি সাড়া দানকারী দলগুলোকে প্রস্তুত থাকতে হবে যে কোনো সংকট মোকাবিলা করার জন্য। তা ছাড়া নিরাপদ যাতায়াত অনুশীলনের ওপর জনসচেতনা প্রচারণা দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সমস্যাগুলোর সমাধান করার জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু শুধু প্রতিশ্রুতি যথেষ্ট নয়। নাগরিকরা রমজান এবং ঈদের সময় তাদের সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য বাস্তব, স্পষ্ট পদক্ষেপ প্রত্যাশা করেন। স্বচ্ছ মনিটরিং, সময়মতো হস্তক্ষেপ এবং কঠোরভাবে বিধি বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন এসব প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য। সরকারকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, ব্যবসায়িক সম্প্রদায়, পরিবহন কর্তৃপক্ষ এবং সাধারণ জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে কার্যকর সমাধান বাস্তবায়নের জন্য।
রমজান হলো বিশ্বাস, সংযম, আত্মশৃঙ্খলা এবং সাম্প্রদায়িক বন্ধন তৈরির এক পবিত্র সময়, যা মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য আত্মশুদ্ধি ও আত্মনিয়ন্ত্রণের এক মহৎ সুযোগ। তবে সঠিক শাসন ব্যবস্থা ও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির অভাবে সাধারণ জনগণকে প্রায়ই অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নিরাপত্তাজনিত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, বাজারের অস্থিরতা, যানজট ও নিরাপত্তাহীনতা অনেকের রমজানের পবিত্রতা ও ঈদের আনন্দকে ম্লান করে দিতে পারে।  
সরকারের দায়িত্ব হলো সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে জনগণ নির্ভয়ে ও নির্বিঘ্নে রোজার মাস সন্তুষ্টির সঙ্গে অতিবাহিত করতে পারে। বাজার তদারকি, ন্যায্যমূল্যে পণ্য সরবরাহ, যানবাহন ও জনসাধারণের চলাচলে শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিশ্চিত করা অপরিহার্য। বিশেষত, ঈদের আগে ও পরে নিরাপদ যাতায়াত ও সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। যাতে মানুষ আর্থিক চাপ বা নিরাপত্তার শঙ্কা ছাড়াই পরিবার-পরিজনের সঙ্গে আনন্দঘন মুহূর্ত কাটাতে পারে। এসব মৌলিক অধিকার ও নাগরিক প্রত্যাশার বাস্তবায়ন শুধু সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধি করবে না; অধিকন্তু রমজানের প্রকৃত চেতনা- সহমর্মিতা, সংযম, ন্যায়বিচার ও সর্বজনীন কল্যাণ-সমুন্নত রাখতে সহায়তা করবে, যা একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে সহায়ক।
লেখক :  অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

×