
দেশে চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতার বিষয়টি সুবিদিত। জনসংখ্যা অনুপাতে পর্যাপ্ত চিকিৎসক-নার্স-আয়াসহ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও শয্যা সংখ্যা নেই। কিছু প্রাইভেট ক্লিনিক থাকলেও সেগুলোতে চিকিৎসা ব্যয় অত্যন্ত বেশি, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে নির্বাহ করা দুঃসাধ্য। গ্রামাঞ্চলসহ প্রত্যন্ত অঞ্চল ও চরাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা অপ্রাপ্তির বিষয়টি না বলাই ভালো। সর্বোপরি রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ভুয়া প্যাথ ল্যাব ও ক্লিনিকের ছড়াছড়ি। সেসব স্থানে গিয়ে সাধারণ মানুষ ও রোগীর প্রতারিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। অবহেলায় মৃত্যুর খবরও আছে। তদুপরি বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবার অভাব প্রকট। যে কারণে অধিকাংশ জটিল ও দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি, বিশেষ করে যারা সচ্ছল তারা চলে যান দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে। এ সবই দেশের চিকিৎসা সেবার অপর্যাপ্ততা ও অপ্রতুলতা প্রকট করে তোলার জন্য যথেষ্ট।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএস পরিচালিত এক জরিপে উঠে এসেছে এসব তথ্য। দেশের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন মানুষের সরকারি হাসপাতালের অবহেলা, অযত্ন ও অপচিকিৎসার শিকার হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। গ্রামের চেয়ে শহরে এই হার বেশি। দেশের ৯১ শতাংশ মানুষ চান, সরকার যেন সব মানুষকে অন্তত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে আইনগতভাবে বাধ্য থাকে। কেননা চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম, যা স্বীকৃত রয়েছে জাতীয় সংবিধানে। উল্লেখ্য, দেশের মানুষের সার্বিক স্বাস্থ্য খাত নিয়ে এই মন্তব্য উঠে এসেছে স্বাস্থ্য খাত সংস্কারবিষয়ক জনমত জরিপে। কমিশনের অনুরোধে এই জরিপ পরিচালনা করেছে বিবিএস।
দেশে সকল নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্যসেবা সুগম করা যায়নি, এটি বাস্তবতা। সব সরকারই চেষ্টা করেছে সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র শ্রেণির চিকিৎসার সুযোগ করে দিতে। কতটুকু সাফল্য এসেছে, সেটি প্রশ্নবিদ্ধ। অন্যদিকে, বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা দিন দিন ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে। ওষুধের দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়ায় একমাত্র উচ্চবিত্ত শ্রেণি ছাড়া সবার ক্ষেত্রেই যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা গ্রহণ দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস ১৯৯৭-২০২০’ প্রতিবেদনে স্বাস্থ্যব্যয়ের একটি হিসাব মিলেছিল। তাতে দেখা যায়, স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয়ের অংশ বছর বছর কমছে। বিপরীতে ব্যক্তির ব্যয় দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে স্বাস্থ্য ব্যয়ের তিন-চতুর্থাংশ বহন করছেন ব্যক্তি নিজেই। এটি ভাবনার বিষয়। স্বাস্থ্য খাতে শুধু বাজেট বাড়িয়ে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ডাক্তার-নার্সসহ প্রধানত ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ। চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রতিবছর ৬২ লাখের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। রোগগ্রস্ত মানুষের মতো অসহায় আর কেউ নেই। নাগরিকের অসহায়ত্ব দূর করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সেই দায়িত্ব পালন যাতে সুষ্ঠু ও কার্যকর হয়, সেজন্য স্বাস্থ্য খাতে সুদূরপ্রসারী যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণের বিকল্প নেই।