
ছবি: জেসমিন আক্তার
ভাষা শুধুমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম নয়; এটি একটি জাতির পরিচয়, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক চেতনার প্রতিফলন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন কেবলমাত্র বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার লড়াই ছিল না, বরং এটি ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার প্রথম বিদ্রোহ। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি শুধু ভাষার নয়, বরং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির দাবিও তোলে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের যে বীজ বপন হয়েছিল, তা পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়। তবে একুশের চেতনার প্রকৃত অনুধাবন তখনই সম্ভব, যখন আমরা ভাষা, ক্ষমতা এবং অর্থনীতির পারস্পরিক সম্পর্ককে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করি।
ব্রিটিশদের শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার সংগ্রামে এ অঞ্চলের মানুষ দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর ভর করেই পাকিস্তান অর্জন করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার বদলে তারা পেয়েছিল উপনিবেশিক শাসনের নতুন রূপ - পাকিস্তান, যেখানে পূর্ব বাংলা ছিল নিছকই একটি উপনিবেশ। স্বাধীনতার মাত্র এক বছরের মাথায়ই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, প্রকৃত মুক্তি আসেনি। উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, যা জনগণের আকাঙ্ক্ষার বিপরীত ছিল। ফলে ভাষা আন্দোলন শহর থেকে গ্রাম-মহল্লায় ছড়িয়ে পড়ে। তখন উচ্চকণ্ঠে দাবি ওঠে "রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই!"
এখানে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে রাষ্ট্রভাষা উর্দু হলে কৃষক, শ্রমিক ,চাষাদের কী ক্ষতি হতো? রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে যাদের সরাসরি কোন সম্পৃক্ততা নেই, তারা কেন রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে সোচ্চার হয়েছিল? এর উত্তর নিহিত আছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক দাসত্ব থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়। পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত কৃষকরা, যারা পাট রপ্তানির মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হচ্ছিল, তাদের সন্তানেরা তখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। ভাষার প্রশ্নটি কেবল শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষার লড়াই ছিল না, বরং এটি পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল।
ভাষার দাবিতে বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারির আত্মত্যাগ ছিল এই জনপদের বড় একটি বিদ্রোহ। তরুণেরা প্রাণ দিয়ে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিল এবং বুঝতে পেরেছিল যে দ্বিজাতিতত্ত্ব তাদের প্রকৃত মুক্তি দিতে পারেনি। তারা বুঝতে পেরেছিল যে, ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হলেও পাকিস্তানের শাসন কাঠামোতে তারা নতুন এক উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। তাই নতুন করে উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয়। এই প্রেক্ষাপটে ভাষা আন্দোলনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বের বদলে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ধারণা উপস্থাপন করে। জনগণ আবারও পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখল, যা বাস্তবায়িত হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে।ফলে পৃথিবীর ইতিহাসে ভাষার ভিত্তিতে প্রথম জাতিরাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেয় বাংলাদেশ।
এখানে মনে রাখতে হবে, জনগণ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব আলাদা সত্তা। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান আন্দোলন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দুটিই রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরিকল্পিত প্রচেষ্টা। কিন্তু জনগণের দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলো ছিল নিজেদের দাসত্ব থেকে মুক্তির সংগ্রাম। ব্রিটিশ শাসন ও বর্ণহিন্দুর আধিপত্য থেকে মুক্তির জন্য তারা দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে লড়াই করেছিল, কিন্তু পাকিস্তান তাদের মুক্তি দিতে পারেনি। এরপর নতুন উপনিবেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তারা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ধারণায় লড়াই করেছিল।
পশ্চিমবঙ্গের নিম্নবর্গের ইতিহাস নিয়ে কাজ করা সাবঅলটার্ন তাত্ত্বিকদের লেখা পড়ে এটি আরও স্পষ্ট হয় যে, ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নিম্নবর্গের মানুষের বিপুল সম্পৃক্ততা থাকলেও তাদের লক্ষ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের মতো রাষ্ট্র গঠন ও ক্ষমতায় বসা ছিল না। বাংলাদেশের বাস্তবতাও এর ব্যতিক্রম নয়। এখানেও নিম্নবর্গের মানুষ আধিপত্যশীল কাঠামো পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করেছিল, ক্ষমতায় বসার জন্য নয়।অতএব, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিকাশ এবং তার ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা এই ইতিহাস বিশ্লেষণ ছাড়া একুশের চেতনাকে বোঝা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
ইউনেস্কোর এক গবেষণা তথ্যানুযায়ী, প্রতি পনেরো দিনে একটি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে। এই বাস্তবতাকে গভীরভাবে বোঝার জন্য আমাদের ক্ষমতা ও আধিপত্যের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। বিশ্বায়নের যুগে পুঁজিবাদী মুক্তবাজার অর্থনীতির বিস্তারের ফলে ভাষাকেও এখন বাজারের মানদণ্ডে মূল্যায়ন করা হয়। অর্থনৈতিক শক্তিই নির্ধারণ করে কোন ভাষা টিকে থাকবে, আর কোন ভাষা বিলুপ্ত হবে। ইংরেজি ভাষার বিস্তার অর্থনৈতিক শক্তির ফল, যেখানে জাপান তার নিজস্ব অর্থনৈতিক বলয়ের কারণে ইংরেজির উপর নির্ভরশীল নয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ায় বাংলা এখানকার আধিপত্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে, বিশেষত ক্ষুদ্র
অন্যদিকে,আফ্রিকার প্রায় ২৯টি দেশে ফরাসি ভাষা সরকারি বা প্রশাসনিক ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে আলজেরিয়া, সেনেগাল, আইভরি কোস্ট, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, ক্যামেরুন, মালি, নাইজার, চাদ, গ্যাবন, রুয়ান্ডা, মাদাগাস্কার, এবং বুরুন্ডি উল্লেখযোগ্য। ১৯শ শতাব্দীতে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো, বিশেষ করে ফ্রান্স, আফ্রিকার বিশাল অংশ দখল করে ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়। ১৮৮৪-১৮৮৫ সালের বার্লিন কনফারেন্সে আফ্রিকা ভাগাভাগির মাধ্যমে ফ্রান্স পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকায় তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ফরাসি ভাষাকে প্রশাসন, শিক্ষা ও আইনের মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে দমন করা হয়।
ফ্রান্স আফ্রিকায় তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বজায় রাখে ঔপনিবেশিক ও নব্য-ঔপনিবেশিক নীতির মাধ্যমে। প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণ, মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ (CFA ফ্রাঙ্ক), এবং সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ফ্রান্স আফ্রিকান দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা সীমিত করেছে। এর ফলে আফ্রিকান দেশগুলোর সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতি দমন, শিক্ষা ও প্রশাসনে ফরাসি ভাষার প্রাধান্য, এবং সম্পদ শোষণের মাধ্যমে আফ্রিকান দেশগুলোর ঐতিহ্য ও অর্থনৈতিক বিকাশ ব্যাহত হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় আফ্রিকা ঔপনিবেশিক ও নব্য-ঔপনিবেশিক শোষণের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব মোকাবিলা করছে।
ইউনেস্কোর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য শুধু বিস্মিতই করেনি, বরং আমাদের ভীতও করেছে। ২০০৮ সালের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে প্রকাশিত ‘বিপন্ন ভাষা’র মানচিত্রে উঠে এসেছে এক আশঙ্কাজনক চিত্র বিশ্বের ছয় হাজার ভাষার মধ্যে ২৪৯৮টি ভাষাই বিপন্ন। ভাষাগুলোর এই সংকটকে পাঁচটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে প্রথমত, শিশুরা যে ভাষায় কথা বলে, কিন্তু সর্বত্র নয়, এমন ৬০৭টি ভাষা বিপন্ন। দ্বিতীয়ত, যে ভাষা শিশুদের শেখানো হয় না, এমন ৬৩২টি ভাষাকে নিশ্চিতভাবে বিপন্ন বলা হয়েছে। তৃতীয়ত, দাদা-দাদিরা যে ভাষায় কথা বলেন, কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম তা ব্যবহার করে না, এমন ৫০২টি ভাষাকে ভয়াবহ বিপন্ন ধরা হয়েছে। চতুর্থত, বয়স্কদের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং ভুলে যেতে বসা ৫৩৮টি ভাষা চূড়ান্ত বিপন্ন। সর্বশেষ, যে ভাষায় আর কেউ কথা বলে না, এমন ২১৯টি ভাষাকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
এই ভাষাযুদ্ধের জটিলতায় বাংলা ভাষাও আধিপত্য ও প্রান্তিকতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে পাঁচটি ভাষাকে বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে - ককবরক, বিষ্ণুপ্রিয়া-মণিপুরী, কুরুক্সু বিপন্ন; বম নিশ্চিতভাবে বিপন্ন; আর সাক ভয়াবহ বিপন্ন। মধ্যবিত্ত ও অভিজাত শ্রেণি বাংলা একাডেমির মাধ্যমে ‘অ-প্রমিত’ বাংলাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে, যেন তাদের নির্ধারিত ‘প্রমিত’ বাংলা একমাত্র বৈধ ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ভাষাগত শ্রেণিবৈষম্যের শিকড় ঔপনিবেশিক আমলেই প্রোথিত হয়েছিল, যেখানে ভাষাকে চাকরের ভাষা, চাষার ভাষা, বাবুর ভাষা, সাহিত্যিক ভাষা ইত্যাদিতে বিভক্ত করা হয়েছিল। এমনকি আজও আনুষ্ঠানিক বাংলা ও আঞ্চলিক বাংলার মধ্যে এই বিভেদ লক্ষ করা যায়।
বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা, বিশেষত নিউ-লিবারেল বাজার অর্থনীতি, ভাষার এই সংকটকে ত্বরান্বিত করছে। বিশ্বায়নের নামে যে এককেন্দ্রিকীকরণ চলছে, তা এক নির্দিষ্ট ভাষা, সংস্কৃতি ও মতাদর্শকে সার্বজনীন করার প্রয়াস মাত্র। যেভাবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে, ঠিক সেভাবেই ইংরেজির মতো ভাষাগুলো সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছে।
ভাষার প্রশ্ন আসলে ক্ষমতা ও পুঁজির প্রশ্নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদও এই সমস্যার সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়েছে, কারণ প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজ এখনো গড়ে ওঠেনি। একুশের চেতনা এবং জাতিরাষ্ট্রের মধ্যে যে সংঘাত, তার মূলে রয়েছে অংশগ্রহণের সংকট। জাতিরাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রতিটি নাগরিকের ভাষাগত অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে কি না, সেটাই প্রকৃত প্রশ্ন। জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ভাষার সংকট নিরসনের পরিবর্তে ক্ষমতার বৈষম্যকে আরও জটিল করে তুলছে।
ভাষার প্রশ্ন কেবল সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের বিষয় নয়, এটি ক্ষমতা, পুঁজি এবং আধিপত্যের সঙ্গেও গভীরভাবে সম্পর্কিত। একদিকে, ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদ গঠনের ভিত্তি স্থাপন করলেও, অন্যদিকে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ভাষা একটি নতুন সংকটে নিপতিত হয়েছে। ইংরেজিসহ প্রভাবশালী ভাষাগুলোর আধিপত্য ক্ষুদ্র ভাষাগুলোর অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলছে, ঠিক যেমনটা বিশ্বায়ন ও পুঁজিবাদী মুক্তবাজার অর্থনীতি বৈষম্য বাড়িয়ে তুলছে। তাই একুশের চেতনাকে শুধু অতীতের ইতিহাস হিসেবে দেখলে চলবে না; বরং তা হতে হবে বর্তমান ও ভবিষ্যতের ভাষাগত বৈচিত্র্য রক্ষার জন্য লড়াইয়ের প্রেরণা। ভাষার প্রকৃত স্বাধীনতা তখনই সম্ভব, যখন প্রতিটি জনগোষ্ঠীর ভাষাগত অধিকার ও সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে সমানভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
মোছা:জেসমিন আক্তার
শিক্ষার্থী, দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ,দিনাজপুর
মুহাম্মদ ওমর ফারুক