
অমর একুশের ঐতিহ্যিক ও সাংস্কৃতিক পর্ব পার করে আমরা এখন স্বাধীনতা দিবসের দ্বারপ্রান্তে। যা সংগ্রামী বাঙালির বহু কষ্টে অর্জিত এক বিজয় নিশানার স্বাপ্নিক বাতাবরণ। বীর ও লড়াকু বাঙালি আবহমান কালের স্বাধীনচেতা এক মনোশক্তি। ব্রিটিশ পূর্ব ভারতে কোনো দিল্লির রাজন্যবর্গ আবহমান বাংলাকে পদানত করতে না পারাও চিরায়ত বঙ্গভূমির পরম নির্মাল্য। শুধু তাই নয়, উন্নত মম শিরে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো এক অপরাজেয় অষ্ট্রিক জাতিগোষ্ঠী। যারা কখনো দিল্লির বশ্যতাও স্বীকার করেনি। দিল্লির মসনদে রাজবংশের পর রাজবংশের উত্থান পতন হয়েছে কিন্তু শস্যশ্যামল চিরায়ত বাংলাদেশে তার আঁচড় পর্যন্ত লাগেনি বলে সমাজ বিশ্লেষকদের মূল্যবান তথ্য-উপাত্তে জানা যায়। এই প্রসঙ্গে সমাজ বিজ্ঞানী কার্ল মার্কসের উক্তি স্মরণ করা যায়Ñ ব্রিটিশ পূর্ব ভারতে যত জাতি ভারত প্লাবিত করেছে তারা এসেছিল শুধু মানুষ হিসেবে। মধ্য যুগের বর্বর জাতিগোষ্ঠীর আক্রমণে দিল্লি পদানত হলেও শ্যামল সবুজ বাংলাদেশে তার সামান্যতম আঁচড়ও বসেনি। ব্রিটিশরাই প্রথম জাতি যারা ভারতীয় সভ্যতা থেকে উন্নততর সেই হেতু অনধিগম্যও ছিল। সঙ্গত কারণে বহু রাজবংশের ছত্রছায়ায় সমৃদ্ধ শ্যামল বাংলার সবুজ প্রান্তরকে কোনো ভাবেই স্পর্শ করার সুযোগই হয়নি। কূটকৌশলে ব্রিটিশরাই প্রথম অপরাজেয় বাংলায় তাদের ঘাঁটি তৈরি করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নামে বাণিজ্যিক পসরা সাজিয়ে বাংলাদেশে যে নতুন ব্যবসার ফাঁদ পাতা হলো তাই এই বরেন্দ্র পলিমাটির অঞ্চলের অধীনতার ইতিবৃত্ত। ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবসকে ঐতিহাসিক পথপরিক্রমায় আলোকপাত করতে গেলে সার্বিক ঘটনাপঞ্জি ও ঐতিহ্যিক পরিমণ্ডল সামনে এসে যায়। ইংরেজ ঐতিহাসিকরাও স্বীকার করেছেন ১৭৫৭ সালে ক্লাইভের হাতে বাংলার পতন না হলে ১৭৬০ সালে ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব হতো কি না তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। জেমস ওয়াট আবিষ্কৃত ইস্টিম ইঞ্জিনের আগেও নাকি বহু বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে। এমনও অভিমত ব্যক্ত করা হয় ১৭৫৭ সালের বাংলার পতনই ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তির প্রভাব প্রতিপত্তির মূল কারণ। ১৭৬০ সালের ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের সূতিকাগার। যার পর পরই বাংলা ১২৭৬ ও ইংরেজি ১৭৬৯ সালে বাংলাদেশে যে মহামনন্বতর তাও ইতিহাসের দুর্যোগপূর্ণ অধ্যায়। এতে বাংলার ৩ ভাগের ১ ভাগ লোক মারা যায় বলে তৎকালীন ইতিহাসবিদদের লেখায় স্পষ্ট হয়ে আছে। আবার ’৪৭-এর দেশ বিভাগও বাংলাদেশের জন্য কোন মঙ্গল বারতা নিয়ে না আসাও আর এক দুর্বিপাক। পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠীও আমাদের বাংলাদেশকে নিরাপদ, নির্বিঘ্নে থাকতেই দেয়নি। যার কারণে আলাদা এক ভূখণ্ড হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় উপমহাদেশের আর এক মহাবিজয় তো বটেই। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৪৮ সালে জিন্নাহর একমাত্র রাষ্ট্্র ভাষা হিসেবে উর্দুকে সামনে আনাও ছিল সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ওপর নব্য অন্যমাত্রার অপঘাত। বীর বাঙালিরা তাও মেনে নেয়নি। পাকিস্তানি অভ্যুদয়ের ৫ বছরের মধ্যে লড়াকু বাঙালি ভাষার প্রশ্নে আপোসহীন এক বিপ্লবী অভিযাত্রায় শামিল হয়। যা কি না ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ রক্তস্নাত প্লাবনে সয়লাব হতেও সময় লাগেনি। ভাষার প্রশ্নে আপোসহীন লড়াইয়ে বীর বাঙালি যে আত্মাহুতি, রক্তের বন্যায় ভেসে যাওয়া তাও ইতিহাসের লোহিত সাগর পাড়ি দেওয়া সেখানেও সফলকাম অকুতোভয় বাঙালি বাংলাকে মাতৃভাষা রূপে অলঙ্কৃত করতে যা যা প্রয়োজন সবটাই করতে অনড় ছিল। শ্যামল বাংলার তার পরেও মুক্তি মেলেনি। লড়াইয়ে ময়দান ছাড়ার অবকাশও হয়নি। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা থেকে চিরস্থায়ী পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে গিয়ে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে বাংাদেশের অভ্যুদয় ঐতিহাসিক যাত্রাপথের আলোকজ্বল অধ্যায়। ৩০ লাখ শহীদানের বিনিময়ে অর্জিত বহু কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা শেষ অবধি অরক্ষিত না থাকাও জাতীয় বিপর্যয়। ২ লাখ মা-বোনের পবিত্র সম্ভ্রমহানি তাও ছিল পাকিস্তানি সামরিক গোষ্ঠীর নৃশংস ক্ষতবিক্ষত আঁচড়। তেমন লড়াই সংগ্রামে নয় মাসের অতৃপ্ত অস্থিরতায় বীর সেনানি বাঙালিরা দমে থাকেনি। ১৬ ডিসেম্বরে স্বাধীনতা সূর্যের নব অভ্যুদয় মহিমান্বিত এক অনন্য অধ্যায়। তেমন যাত্রাপথও নির্বিঘ্ন আর নিঃসংশয় থাকেনি। যে কোনো লাগাতার শাসনামল গণতন্ত্রহীনতা ও অধিকার বঞ্চনার চিরায়িত বৃত্তবিধি, যা ২০০৯ থকে ২০২৪ পর্যন্ত ধারাবাহিক দুঃশাসনের আর এক করুণ ইতিবৃত্ত ইতিহাসের কলঙ্কিত ভিন্ন মাত্রার বাতাবরণ। তাই ২০২৪ এর ছাত্র আন্দোলনও ছিল কাক্সিক্ষত ও পরিস্থিতির ন্যায্যতা। মনে পড়ছে ইংরেজ ঐতিহাসিক হেনরি নেভিংসনের মূল্যবান আর এক চিরন্তন বাক্য চয়ন। কয়েক ধাপ এগিয়ে তিনিও বললেনÑ স্বাধীনতাকে নাকি প্রেমের মতো নিত্য জয় করতে হয়। প্রতিবার জয়ের পর নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকলে বহু কাক্সিক্ষত প্রেমকেও হারাতে হয়। স্বাধীনতাও নাকি তাই। বারবার জয় করার আর এক চিরস্থায়ী সোপান তো বটেই। ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান তারই প্রকষ্ট নজির। এবার লাগাতার ১৬ বছরের দুঃশাসনে শিক্ষার্থীরাই নামলেন আবারও হারানো স্বাধীনতাকে বিজিত করতে। অকুতোভয় সৈনিকের মর্যাদায় শিক্ষার্থীরাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের কষাঘাতে আর এক নতুন বাংলাদেশ উপহার দিয়ে প্রমাণ করলেন কোনো দুঃশাসনই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। সেখানে কবি গুরু বলছেন শিক্ষা ব্যবস্থায় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ। ভাষার মাস পেরিয়ে আমাদের স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও লড়াই বিপ্লবকে আলিঙ্গন করতে হয়। যা ২০২৪ এর উদ্দীপ্ত বিক্ষোভ আর আপোসহীন লড়াইয়ের আর এক বৈপ্লবিক রক্তস্নাত অসহনীয় এক দুর্বার প্রতিরোধ। যা কি না লাগাতার স্বৈরশাসককে মসনদচ্যুত করতে খুব বেশি সময়ও লাগেনি। দীর্ঘকালীন অপশাসনের মূল কাঠামো ভিত্তি বরাবরই নড়বড়ে থাকে যা ইতিহাস সিদ্ধ এবং তিক্ততার করুণ বাতাবরণও বটে। তাই ভাষার মাস পেরিয়ে স্বাধীনতার মার্চকে স্পর্শ করতে নতুনভাবে জাগিয়ে তোলা জরুরি ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের আর এক বিজয়গাথা বরমাল্য।