
এল নিনো হলো প্রশান্ত মহাসাগরের নির্দিষ্ট অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে উষ্ণ হয়ে ওঠার একটি প্রাকৃতিক ঘটনা, যা বৈশ্বিক আবহাওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) ২০২৩ সালে এল নিনোর আবির্ভাব নিশ্চিত করে, যা ২০২৪ এবং ২০২৫ সালে তার পূর্ণ প্রভাব প্রদর্শন করছে। ডব্লিউএমওর মতে, এল নিনোর ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে, যা পৃথিবীর উষ্ণতম বছরগুলোর মধ্যে একটি হতে পারে।
বাংলাদেশের কৃষিতে এল নিনোর প্রভাব : বাংলাদেশের কৃষি প্রধানত বর্ষাকালের বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভরশীল। এল নিনোর প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যায় এবং তাপমাত্রা বেড়ে যায়, যা ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত এবং তীব্র তাপপ্রবাহ লক্ষ্য করা গেছে, যা আউশ ধান, কাঁচা মরিচ এবং গ্রীষ্মকালীন সবজির উৎপাদনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের (বিএমডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুনে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ১৬ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেও বৃষ্টিপাতের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকার সম্ভাবনা রয়েছে, যা রবি ফসলের উৎপাদনে প্রভাব ফেলতে পারে।
২০২৫ সালে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ : চলতি বছর এল নিনোর প্রভাব আরও তীব্র হতে পারে। কম বৃষ্টিপাতের ফলে আমন ও বোরো ধানের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, খরা ও খাদ্যনিরাপত্তার হুমকি বাড়তে পারে। এছাড়া তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে গ্রীষ্মকালীন সবজি ও ফলের উৎপাদনেও সমস্যা দেখা দিতে পারে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে আউশ ধানের চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩.৯৫ লাখ হেক্টর। কিন্তু চাষ হয়েছে ১০.৫৫ লাখ হেক্টরে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম। এল নিনোর প্রভাবে এই প্রবণতা ২০২৫ সালেও অব্যাহত থাকতে পারে।
গবাদিপশু ও মৎস্য খাতে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ : গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি খাতেও এল নিনোর প্রভাব পড়তে পারে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে গবাদিপশুর তাপজনিত রোগ, খাদ্য সংকট এবং উৎপাদন হ্রাসের সম্ভাবনা রয়েছে। খামারিদের জন্য বাড়তি পশুখাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে এবং গবাদিপশুকে খরা সহনশীল চারণভূমি ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যেতে হবে। মৎস্য খাতেও সমস্যা হতে পারে। বিশেষ করে চিংড়ি ও মিঠা পানির মাছের উৎপাদন হ্রাসের আশঙ্কা রয়েছে। উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে জলাশয়ে অক্সিজেনের ঘাটতি হতে পারে, যা মাছের মৃত্যুর হার বাড়াতে পারে। এক্ষেত্রে, মাছের ঘনত্ব কমিয়ে জলমান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং গভীর পানির পুকুর ব্যবহারের দিকে নজর দিতে হবে।
কৃষি বাজার ও অর্থনৈতিক সংকট : কৃষিপণ্যের বাজারেও এল নিনোর প্রভাব লক্ষ্য করা যেতে পারে। ফসল উৎপাদন কমে গেলে বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে, যা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করবে। বিশেষ করে চাল, ডাল, শাক-সবজি এবং ফলমূলের দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষকদের আয় কমে যাওয়ায় তারা আর্থিক সংকটে পড়তে পারেন, ফলে ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়বে। সঠিক সময়ে সহায়তা না পেলে কৃষকদের অনেকে বিকল্প পেশার দিকে যেতে বাধ্য হতে পারেন, যা কৃষি খাতে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
কৃষক বাজার ও ডিজিটালাইজেশন : বাংলাদেশের কৃষি খাতে ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কৃষকরা সরাসরি বাজারে ফসল বিক্রি করতে পারেন এবং তাদের পণ্য মূল্য সম্পর্কে আরও তথ্য পেতে পারেন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে। বর্তমানে কৃষকরা কৃষি বাজারে তাদের পণ্য বিক্রি করার জন্য ডিজিটাল অ্যাপ এবং অনলাইন মার্কেটপ্লেস ব্যবহার করতে শুরু করেছেন, যা তাদের জন্য বাজারে আরও প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা প্রদান করে। কৃষকদের জন্য ডিজিটাল মার্কেটিং এবং শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম গঠন করা হলে, তারা সহজে তাদের পণ্যের মূল্য জানাতে পারবে এবং বাজারের মন্দাভাব কাটিয়ে উঠতে পারবেন। এল নিনোর প্রভাব মোকাবিলায় কৃষকদের লাভজনক দাম পাওয়ার জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাজার ব্যবস্থাপনায় মনোযোগী হতে হবে। প্রাথমিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, দেশের কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের সঠিক মূল্য পান না। এর ফলে তাদের কৃষি উদ্যোগে আস্থা কমে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে, বাজারের ট্রান্সপারেন্সি এবং সঠিক দামের ব্যবস্থা করা কৃষকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাজার ব্যবস্থাপনা এবং সরবরাহ শৃঙ্খলা আরও কার্যকর হলে কৃষকরা লাভজনক দামে তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারবেন।
করণীয় : এল নিনো বা অন্যান্য জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশের কৃষির ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। কম বৃষ্টিপাত, খরা, এবং পানি সংকটের কারণে সেচ ব্যবস্থার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি। আধুনিক সেচ পদ্ধতি ও প্রযুক্তি যেমন সোলার সেচ, ড্রিপ সেচ এবং পানির সাশ্রয়ী ব্যবহারের কৌশল গ্রহণ করলে পানি ব্যবস্থাপনা আরও কার্যকর হতে পারে। সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে জল সংরক্ষণের প্রযুক্তি ও ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এই প্রেক্ষিতে, জলাধার ও খাল পুনঃখনন যেমন বড় ভূমিকা রাখতে পারে, তেমনি এটি পানি সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। এছাড়া খরা সহিষ্ণু ফসলের চাষ কৃষকদের জন্য একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে। বাংলাদেশের কৃষি খাতে ফসলের জাত পরিবর্তনের মাধ্যমে খরা সহিষ্ণু ও স্বল্পমেয়াদি ফসলের চাষাবাদে গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এবং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ইতোমধ্যে কিছু খরা সহিষ্ণু ধান ও অন্যান্য ফসলের জাত উদ্ভাবন করেছে। এই জাতগুলোর চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করা প্রয়োজন, যাতে তারা কম পানিতেও ভালো ফলন পেতে পারেন। কৃষকদের এসব প্রযুক্তি সম্পর্কে অবহিত করার জন্য প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। আধুনিক কৃষি পদ্ধতির ব্যবহার এবং নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে খরার প্রভাব মোকাবিলা করা সম্ভব। এল নিনোর প্রভাব সম্পর্কে কৃষকদের সতর্ক করতে হলে কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) তাদের তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর সতর্কবার্তা প্রদান করতে পারে। মোবাইল অ্যাপ, এসএমএস সার্ভিস এবং কমিউনিটি রেডিওর মাধ্যমে কৃষকদের আগাম সতর্কবার্তা প্রদান করলে তারা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটগুলো মোকাবিলা করতে প্রস্তুত থাকতে পারবেন। এমনকি খাদ্য নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য সরকারের উচিত খাদ্য মজুত ব্যবস্থার উন্নতি করা এবং প্রয়োজনে খাদ্য আমদানি করা। খাদ্যশস্যের সুষ্ঠু বিতরণ নিশ্চিত করা কৃষকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। ফসল বিমা কার্যক্রমও কৃষকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তন এবং এল নিনোর মতো দুর্যোগের কারণে কৃষকরা প্রায়ই ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হন। বাংলাদেশে ফসল বিমার প্রচলন সীমিত, তবে সরকার ও বেসরকারি খাত যৌথভাবে কম খরচে ফসল বিমা চালু করলে কৃষকরা আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে কিছুটা রক্ষা পেতে পারেন। এ ধরনের ব্যবস্থা কৃষকদের সুরক্ষা দেয় এবং তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য সহায়ক হতে পারে। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে কৃষি খাতের স্থিতিশীলতা ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।
এল নিনোর প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশের কৃষি খাতকে আরও বিজ্ঞানসম্মত এবং প্রযুক্তিনির্ভর বানানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় সরকারের নীতি-সহায়তা ও গবেষণা প্রয়োজন, যা কৃষকদের জন্য সহনশীল প্রযুক্তি, সেচ পদ্ধতি ও বিমা সুবিধা নিশ্চিত করবে। আধুনিক কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করে এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের সক্ষমতা বাড়ানো যাবে। কৃষকদের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছানোর জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং মোবাইল অ্যাপস ব্যবহার করা যেতে পারে, যাতে তারা বাজারের দর এবং আবহাওয়া পূর্বাভাস সম্পর্কে জানতে পারে। এল নিনোর প্রভাবের কারণে খাদ্য নিরাপত্তা সংকটে পড়ে যেতে পারে। তাই সরকারকে খাদ্য মজুত ব্যবস্থা এবং সুষ্ঠু বিতরণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষি বাজার ও বাজারের ডিজিটালাইজেশন একে অপরকে সমর্থন করে খাদ্যশস্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দেশের কৃষি খাতের টেকসই উন্নতির জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং সহযোগিতা অপরিহার্য।
লেখক : টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট ও রিসার্চ অ্যাডভাইজার,
কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন