
ছবি : সংগৃহীত
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বর্তমান আন্তর্জাতিক সংকটে বাংলাদেশও একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছে। নানা কারণে বাণিজ্য ও স্থানীয় শিল্প কিছুটা স্থবির। স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলা, প্রতিকূল অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে প্রান্তিক ও স্বল্প আয়ের মানুষের খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত, ক্ষুদ্র ব্যবসা এবং কৃষিক্ষেত্রকে সচল করতে সরকারকে আগামী অর্থবছরে অর্থায়ন বাড়ানো উচিত। একই সঙ্গে সংস্কার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া, রাজস্ব আদায়কে সুশৃঙ্খল করার জন্য ধনীদের কাছ থেকে কর আদায় বৃদ্ধি এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের প্রণোদনা অব্যাহত রাখা উচিত। বাজেটে সরকারি ব্যয় কমানো এবং বাজেটের ঘাটতি পূরণ করার প্রয়োজনীয়তা অনেক।
বিগত অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেটটি দেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক খাতে প্রভাব বিবেচনায় রেখেই করা দরকার। কারণ, অন্তর্জাতিক সংকট কখন শেষ হয় বলা যাচ্ছে না। চলতি অর্থবছরে কৃষি খাত কার্যকর ও গতিশীল ছিল। বাহ্যিক খাত রেমিটেন্স ছাড়া অন্যান্য খাত মোটেও ভালো যায়নি। এ পরিস্থিতিতে আসন্ন আর্থিক বছরের জন্য বাজেটটি প্রসারণযোগ্য হতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা ইস্যুতে জিডিপির ৫ থেকে ৭ শতাংশ বরাদ্দ করা প্রয়োজন। মুদ্রাস্ফীতি এখনো নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনছে অন্তর্বর্তী সরকার। বাজেটে এই অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। পরে বর্তমান সরকার চলতি অর্থবছরের জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনে। তবে সরকারের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৫ শতাংশের বেশি নাও হতে পারে। তাই আগামী অর্থবছরের বাজেটে সরকারের ব্যয় বাড়াতে হবে। ফলে সম্প্রসারণ ব্যয়নীতি গ্রহণ করা আবশ্যক হতে পারে।রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার জন্য কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সবার আগে লক্ষ্যটি বাস্তবসম্মত কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে। যে করবিহীন খাত থেকে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পেয়েছে সেগুলো বের করা দরকার। কর আদায়ের সময় প্রাপ্ত দুর্বলতাগুলো সমাধান করা দরকার। ট্যাক্স প্রশাসনের উচিত ট্যাক্স প্রদানকারীদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া এবং বর্তমান কর আদায়কারীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ভালো প্রশিক্ষণ কর্মসূচির ব্যবস্থা করা। করদাতাদের বোঝার জন্য আরও সুবিধাজনক উপায়ে ট্যাক্সের বিধি ও পদ্ধতিগুলো সংশোধন করা। কর দায় গণনার জন্য ট্যাক্স স্লাপের পুনর্গঠন, কর প্রদানের জন্য জনসচেতনতা তৈরি করা। তবে আসন্ন বাজেটে রাজস্ব আদায়ের জন্য কর প্রদানকারী এবং কর প্রশাসনের প্রতি করদাতাদের সামগ্রিক নেতিবাচক ধারণা পরিবর্তনের জন্য কর ব্যবস্থা এবং কর প্রশাসনের সক্ষমতা সংশোধন করা উচিত।
ব্যবসায়ীদের স্বল্পমেয়াদি ট্যাক্স সুবিধা বাড়াতে হবে। এজন্য কর ফাঁকির প্রবণতা এবং পথ বন্ধ করতে হবে। দুর্নীতি রোধ করতে হবে। ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করে বাজেটে ওষুধ এবং অন্য আইটেমগুলোকে শুল্কমুক্ত রাখতে ও ইন্টারনেটের ব্যয় হ্রাস করা উচিত। কারণ, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন ক্লাস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ছে। কালো টাকা পাচারের সুযোগ বন্ধে টিআইএনধারীদের রিটার্ন দাখিল করা এবং বিদেশী নাগরিকদের কর পরিশোধের বিষয়টি নিশ্চিত করতে সরকারের বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। বাজেটের ঘাটতি মেটাতে বিদেশী তহবিলের দিকে সরকারের মনোনিবেশ করা উচিত। বাজেট তৈরি করা উচিত এমনভাবে যাতে স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য উৎসাহ দেওয়া, কৃষক, এসএমইগুলোকে উৎসাহ প্রদান এবং ছোট ব্যবসায়ীদের ভ্যাট অব্যাহতি নিশ্চিত করা যায়। বাজেটে শিল্প খাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে করের সুবিধা থাকতে হবে।
জনগণ আশা করে যে, বাজেট স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষাসহ মৌলিক চাহিদা পূরণে অনন্য ভূমিকা পালন করবে। এক সময় সরকার জাতীয় বাজেটের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ দেওয়ার বিশ্বব্যাপী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার শিক্ষার জন্য ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ বরাদ্দ করেছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল জিডিপির এক দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল দুই দশমিক ৮ শতাংশ। ইউনেস্কোর পরামর্শ একটি দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। কিন্তু আমরা সেই পরিমাণ বরাদ্দ শিক্ষা খাতে দিতে পারছি না। চলতি অর্থবছরে সরকার শিক্ষা খাতে ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। ২০৪১ বা ২০৫০ সালের মধ্যে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ, আধুনিক ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে স্মার্ট নাগরিক দরকার। তাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষায় সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সেজন্য শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বেশি রাখা একান্ত প্রয়োজন। অন্য কথায়, মূল্যস্ফীতি ও জাতীয় প্রবৃদ্ধির কথা বিবেচনা করে অনেক সময় শিক্ষা খাতে বাজেটের বরাদ্দ হ্রাস পেয়েছে, যা আমাদের অবাক করেছে। ইউনেস্কোর শিক্ষার দলিলগুলোতে স্বাক্ষরকারী হিসেবে মোট বাজেটের ২০-২৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা, দেশের গবেষণা খাতকে শক্তিশালী করতে পারে এরকম বলা রয়েছে। শিক্ষার জন্য জাতীয় বাজেটে যে কয়েকটি দেশে কম বরাদ্দ রয়েছে সেখানে বাংলাদেশ অন্যতম। প্রতিবেশী নেপাল, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, মালদ্বীপ এবং আফগানিস্তানও শিক্ষায় বেশি ব্যয় করে।
গবেষণায় যদি বেশি অর্থ বরাদ্দ করা হয় এবং শিক্ষক সেই অনুযায়ী মানসম্পন্ন গবেষণা পরিচালনা করেন, তবে উচ্চতর শিক্ষা টেকসই উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে। অন্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয় করোনাভাইরাস মহামারির সময় টেস্ট কিট বা অ্যান্টিডোটস উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা করেছে। বাংলাদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো করোনা মহামারিতে তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। গবেষণার সরঞ্জামের অভাব এবং স্বল্প আর্থিক বরাদ্দ এই অযোগ্যতার কারণগুলোর মধ্যে প্রধান। আমরা আন্তরিকভাবে সরকারকে এ বিষয়টি আলাদাভাবে বিবেচনা করার জন্য এবং শিক্ষার জন্য আলাদাভাবে একটি বাজেট বরাদ্দের অনুরোধ করছি। উচ্চ শিক্ষায় গবেষণার মানের ব্যাপক উন্নতি ছাড়া টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়ন অসম্ভব।
সরকার আগামী অর্থবছরের বাজেট জুন মাসে ঘোষণা করবে। এটি হবে এ সরকারের প্রথম বাজেট। আন্তর্জাতিক যুদ্ধ, বিপর্যস্ত অর্থনীতি, কর্মসংস্থানের অবস্থা তো অনেক খারাপ। দরিদ্রতা বৃদ্ধি পেয়েছ। নানা কারণে স্বাস্থ্য খাতের নাজেহাল অবস্থা। চোখে পড়ছে নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা, যা খুবই দুঃখজনক। বর্তমান সরকার প্রধান চেষ্টা করছেন। স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক বিতর্কিত ইস্যু প্রকাশ হয় মাঝে মধ্যে। তারপরও নানা সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করাই বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে বাজেটে। ব্যবসায়ীরাও তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে চেয়ে আছেন সরকারের নতুন বাজেটের দিকে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, প্রবৃদ্ধি নয়, বাজেট এমন হওয়া উচিত যাতে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব। আসন্ন বাজেট নিয়ে সকলের এক প্রশ্ন, কেমন বাজেট হবে? বাজেট কি সকল জনগণের আশা পূরণ করতে পারবে?
অর্থ উপদেষ্টার মনে রাখা উচিত, সংবিধান অনুসারে প্রত্যেক নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। তাই স্বাস্থ্য খাতেও বাজেট আগের চেয়ে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত এবং এর সুষম বণ্টনে একটি সময়োপযোগী স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করা জরুরি, যাতে সকলের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়। সর্বোপরি স্বাস্থ্য খাতের যে অনিয়ম ও দুর্নীতি অতীতে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে সেসবের তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ