
কয়েকদিন পর থেকেই শুরু হতে যাচ্ছে পবিত্র রমজান। ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের অন্যতম স্তম্ভ রমজানের রোজা। শুধু আত্মশুদ্ধিই নয়, এ মাস আত্মনিয়ন্ত্রণেরও। রোজার অন্যতম লক্ষ্য মানুষের স্বাস্থ্যগত উন্নতি সাধন। রোজা রাখলে অনেকে স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রোজায় কারও স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে গেছে বা রোজা রেখে ক্ষুধাÑতৃষ্ণায় কাতর হয়ে কারও মৃত্যু হয়েছে, এমন কোনো ঘটনার কথা শোনা যায়নি। রোজা কষ্টকর ইবাদত এবং রোজার দ্বারা শরীরে চাপ পড়ে বলে অনেকেই রোজা ছেড়ে দেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শরিয়তের বিধান অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া রোজা পরিত্যাগ করা সম্পূর্ণ অনুচিত। সুস্থ ব্যক্তি তো বটেই, অনেক অসুস্থ ব্যক্তিরও রোজা ছেড়ে দেওয়া উচিত হবে না।
রমজানে রোজা রাখা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হইয়াছে যেরূপ ফরজ করা হইয়াছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, আশা যে, তোমরা মুত্তাকী হইবে’। (সূরা বাকারাহ-১৮৩) অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সিয়াম বা রোজা নির্দিষ্ট কয়েক দিনের। তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে অথবা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূর্ণ করবে। যাদের জন্য অতিশয় কষ্টদায়ক হয়, তাদের কর্তব্য এর পরিবর্তে ফিদিয়াÑ একজন অভাবগ্রস্তকে খাদ্যদান করা। যদি কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎকাজ করে, তবে তা তার পক্ষে অধিক কল্যাণকর। আর সিয়াম বা রোজা পালন করাই তোমাদের জন্য অধিক কল্যাণকর, যদি তোমরা তা জানতে।’ (সূরা বাকারাহ-১৮৪) আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে, তারা অবশ্যই এ মাসে রোজা রাখিতে হইবে এবং কেউ অসুস্থ অথবা সফরে থাকলে, অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ, তাই চান এবং যা তোমাদের জন্য কষ্টকর, তা চান না, এজন্য যেন তোমরা নির্দিষ্ট সংখ্যা পূর্ণ করতে পার এবং তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা কর তোমাদের হেদায়েত করার দরুন, আর যেন তোমরা শোকর করো।’ (সূরা বাকারাহ-১৮৫)
অতিশয় কষ্ট বলতে অতি বার্ধক্য, চিরস্থায়ী রোগÑ যা অতীব কষ্টকর, তার জন্য এই মাসে রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে। পরে কাজা আদায় করলেই চলবে। অবশ্য কি কি অবস্থায় রোজা রাখা যাবে কি যাবে না, তার সুস্পষ্ট বিধান শরিয়তে আছে। আবার সুনির্দিষ্ট কারণে রোজা রাখতে না পারলে তার পরিবর্তে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ কাজা, কাফফারা, ফিদিয়া বা বদলি রোজা রাখার সুস্পষ্ট বিধান আছে। রোজা রাখায় প্রাণের আশঙ্কা আছেÑ এ কথাটি কোনো আলেম এবং ইসলামী জ্ঞানসম্পন্ন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হতে হবে। গর্ভবতী মহিলার যদি গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা হয় অথবা স্তন্যদায়ী মা যদি রোজা দ্বারা তার নিজের বা তার স্তন্যপানকারী শিশুর ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তবে সেও এই মাসে রোজা না রেখে পরে সুবিধামতো সময়ে কাজা আদায় করতে পারে।
অনেক রোগীই যে কোনো অবস্থায় রোজা রাখতে বদ্ধপরিকর। আবার অনেকেই নিজের মতো অজুহাত তৈরি করে রোজা না রাখার যুক্তি খোঁজেন। আসলে দীর্ঘস্থায়ী রোগেও রোজা রাখা সম্ভব। রোজার মাসে পেপটিক আলসার রোগীরা খালি পেটে থাকবেন, ডায়াবেটিস রোগীরা কিভাবে রোজা রেখে ইনসুলিন নেবেন, উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা কিভাবে দুবেলা বা তিনবেলা ওষুধ সেবন করবেন, এ ছাড়া হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টের রোগী, কিডনি বা হার্টের রোগী, লিভার, চোখ, কান বা নাকের রোগী, বা নারীরা গর্ভ অবস্থায় রোজা রাখবেন কিনা, এসব চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েন। আবার কিছু কিছু অসুস্থ ব্যক্তি, এমনকি সুস্থ ব্যক্তিও দুর্বলতা এবং নানারকম দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনার কারণে রোজা রাখতে গড়িমসি করেন।
আসলে রোজা রাখলে শরীরে তেমন কোনো বিরূপ প্রভাব পড়ে না। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সুচিন্তিত অভিমত হলো, রোজা স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি তো করেই না, বরং শরীর ও মনের উন্নতি লাভের সহায়ক। পেপটিক আলসার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগী, যাদের অতিরিক্ত ওজন ও শরীরে চর্বি বা কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি এবং বাত ব্যথার রোগীরাও সরাসরি রোজায় উপকার পান। যারা ধূমপান ও নেশাজাতীয় দ্রব্য ব্যবহার করেন, রোজায় এগুলো পরিহার করার সুবর্ণ সুযোগ। এর ফলে ক্যান্সার, হৃদরোগ রোগ, স্ট্রোকসহ বহু জটিল রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। যারা দীর্ঘমেয়াদি বা অসংক্রামক রোগে ভোগেন, তাদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও রোজা রাখতে অনেকেই প্রবল আগ্রহী। তারা যদি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোজার মাসের জন্য ঔষধ বিধি ঠিক করে নিতে পারেন, তবে সহজেই রোজা রাখতে পারবেন। এতে রোজা ভাঙার বা রোজা থেকে বিরত থাকার কোনো প্রয়োজন হয় না।
পবিত্র রমজান প্রায় আসন্ন। সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও মুসলিমরা এ মাসে রোজা রাখবেন। রমজান শুরুর আগেই তাঁদের যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। অনেকেই রমজান শুরুর দু-এক দিন আগে এ বিষয়ে সচেতন হন। তখন কোনো শারীরিক সমস্যা বা অস্বাভাবিকতা ধরা পড়লে শোধরানোর সুযোগ থাকে না।
রুটিন চেকআপ ও চিকিৎসকের পরামর্শ : যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, হাঁপানি, থাইরয়েডের সমস্যা বা অন্য কোনো দীর্ঘমেয়াদি রোগ আছে, তারা রমজান শুরুর আগেই চিকিৎসকের পরামর্শে একটি রুটিন চেকআপ সেরে ফেলুন।
(১) সাধারণত রুটিন চেকআপে রক্তের শর্করা, কিডনির অবস্থা বুঝতে ক্রিয়েটিনিন, প্রস্রাবে অ্যালবুমিন, লিভারের জন্য এসজিপিটি, রক্তের সিবিসি, ইলেকট্রোলাইট, লিপিড প্রোফাইল, ফুসফুসের রোগীদের প্রয়োজনে এক্স-রে, হৃদ্রোগীদের ক্ষেত্রে ইসিজি করা হয়ে থাকে।
(২) পরীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী আপনার নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নিন খানিকটা আগেই। কারণ, পুরনো ওষুধের ডোজ পরিবর্তন বা কোনো নতুন ওষুধের সংযোজন দরকার হলে তা শরীরের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার যথেষ্ট সময় পাবেন এতে।
(৩) ডায়াবেটিক রোগীরা রমজানে ইনসুলিন বা খাবার ওষুধের মাত্রা কেমন হবে, ভালোভাবে জেনে নিন। রক্তচাপ, হৃদরোগী, হাঁপানি, কিডনি বা লিভার ও অন্যান্য রোগী নিয়মিত ওষুধের রোজাকালীন ব্যবহারের সময়সূচিও জেনে নিন।
চিকিৎসকের সঙ্গে প্রয়োজনীয় পরামর্শ করুন :
(১) চিকিৎসকের সঙ্গে আপনার বিগত বছরের অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন। এতে তার বুঝতে সুবিধা হবে রমজানে আপনার কোন ধরনের সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। যেমনÑ ডায়াবেটিক রোগীদের বিগত বছরে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়েছিল কি-না কিংবা উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের রক্তচাপে কোনো পরিবর্তন হয়েছিল কি-না, হৃদরোগীদের শ্বাসকষ্ট বেড়ে গিয়েছিল কি-না ইত্যাদি। গতবারের সমস্যাগুলো এবার কিভাবে এড়ানো যায়, সেই পরামর্শ করুন।
(২) যাঁরা পরিপাকতন্ত্রের সমস্যায় ভোগেন, যেমনÑ পেপটিক আলসার, বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য, আই.বি.এস, জি.আর.ডিসহ নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাওয়া-দাওয়াসহ ঔষধপত্রের ব্যবস্থা জেনে নিন।
পুষ্টিবিদের পরামর্শ :
(১) রমজানে আমাদের খাদ্যাভ্যাস অনেকটাই পাল্টে যায়। এতে কারও কারও নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। আবার যাদের ক্রনিক রোগ আছে, তাদের নানা খাবারে নিষেধাজ্ঞা থাকে। রমজানে আমাদের ডাল বা বেসনের তৈরি অনেক খাবার গ্রহণ করা হয়। ভাজাপোড়া খাবারও খাওয়া হয় অনেক। কে কতটুকু খেতে পারবেন, তা নির্ভর করে তার সাম্প্রতিক ক্রিয়েটিনিন, লিপিড প্রোফাইল বা শর্করার রিপোর্টের ওপর।
(২) যাদের আইবিএস, যকৃতের সমস্যা, পেপটিক আলসার, জিইআরডি, কোষ্ঠকাঠিন্য আছে, তারাও খাবার সম্পর্কে জেনে নিন কিসে ভালো থাকবেন। কিডনি ও হৃদরোগীদের অনেক সময় পানির পরিমাণ মেপে দেওয়া হয়। রাতে কতটুকু পানি বা তরল কিভাবে খাবেন, সেগুলো জেনে নিন।
মানুষের রোগের শেষ নেই, ধরনও এক নয়। তাই যেকোনো রোগী যারা রোজা রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অথচ দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভোগেন, তাদের উচিত ইসলামি জ্ঞানসম্পন্ন ডাক্তার বা আলেম-ওলামার সঙ্গে পরামর্শ করে রোজার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। মনে রাখতে হবে, নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগে কিংবা সামান্য অসুস্থতায় রোজা রাখতে কোনো নিষেধ নেই। বরং রোজা রাখা রোগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। তবে তীব্র অসুস্থতা কিংবা জটিল রোগে রোজা রাখা ঠিক হবে না, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন সংশ্লিষ্ট ইসলামি জ্ঞানসম্পন্ন চিকিৎসক।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক