
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানকে পূর্ণতাদানের অভিলক্ষে বাংলাদেশকে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সংস্কার কমিশনগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বেশকিছু প্রস্তাবনা দিয়েছে। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক নাম, মূলনীতি, প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই।
রাষ্ট্রের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বর্তমান সংবিধানে থাকা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’-এর স্থলে ‘জনগণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ গঠন এর কথা বলা হয়েছে। ‘জনগণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ সমীচীন এবং যুক্তিযুক্ত। পূর্ব থেকেই আমরা এ বিষয়টি সামনে এনেছিলাম। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ‘বৈষম্যহীন’ সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ফসল। সুতরাং রাষ্ট্র ও সরকার কতটা কার্যকর গণতান্ত্রিক হলো, কতটা বৈষম্যহীন হলো- এটাই মুখ্য। শুধু নাম নয়। বিশ্বের যেসব রাষ্ট্র এ ধরনের বাহারি নাম ধারণ করেছে তাদের অবস্থা কি তা পর্যালোচনা হওয়া উচিত। বর্তমান সময়ের অন্যতম আলোচিত দেশ উত্তর কোরিয়া। এর অফিসিয়াল নাম ‘ডেমোল্ডেটিক পিপলস্ রিপাবলিক অব কোরিয়া (উচজক)। কিন্তু দেশটিতে একনায়কতন্ত্র বিরাজমান। একইভাবে লাওস নামক দেশটি ‘লাউস পিপলস্ ডেমোল্ডেটিক রিপাবলিক (খচউজ)’ নামে অভিহিত। কিন্তু দেশটি সমাজতান্ত্রিক আদর্শের। অপরদিকে, বিশ্বের অন্যতম সর্বাধুনিক জাতিরাষ্ট্র জাপানের রাষ্ট্রপ্রধান সম্রাট। কিন্তু এর অফিসিয়াল নাম ‘গভর্মেন্ট অব জাপান’। শিক্ষা, সভ্যতা, শিল্প-বাণিজ্য, অর্থনীতি তথা সর্বক্ষেত্রে বিশ্বের রোল মডেল। সুতরাং নামের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রকে বৈষম্যহীন রূপদান। বিদ্যমান সংবিধানের চার মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বাদ দিয়ে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ মূলনীতি হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে। এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। ধর্মনিরপেক্ষতা একটি নিরপেক্ষ আচরণের নাম। আমাদের দেশের মানুষ ধর্মীয় ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ। পূর্বে সমাজতন্ত্র মূলনীতিতে থাকলেও দেশ সমাজতান্ত্রিক ছিল না। সুতরাং ন্যায়ভিত্তিক, জনবান্ধব, মানবিক, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই আসল।
মূলনীতিতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, চার বছর মেয়াদের সংসদ। মালদ্বীপ ব্যতীত সার্ক দেশগুলোতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ বিদ্যমান। রাষ্ট্রপতির মেয়াদ হবে চার বছর এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন ইলেক্টোরাল কলেজ বা নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটের মাধ্যমে। একই ব্যক্তি দু’বারের বেশি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না বলে সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো সুচিন্তিত এবং গণতন্ত্র উন্নয়নে সহায়ক।
প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। চারটি প্রদেশে বিভক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এটা বাস্তবায়ন করা হলে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ হবে। আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনা ও সুষ্ঠু ধারার শাসনের জন্য বিকেন্দ্রীকরণ অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশ জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম দেশ। আয়তনে ছোট হলেও বিরাট জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছতে প্রদেশে বিভক্ত করার বিকল্প নেই।
প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, সীমান্তসহ বৈদেশিক যোগাযোগ, সাহায্য-সহযোগিতার মতো বিষয়গুলো কেন্দ্র সরকারের হাতে রেখে কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে শাসন-প্রশাসন প্রাদেশিক সরকারের কাছে ছেড়ে দিতে হবে। এর ফলে ঢাকাকেন্দ্রিক মানুষের চাপ হ্রাস পাবে। বসবাসের অযোগ্য ঢাকা কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বিকেন্দ্রীকরণ হবে প্রাদেশিক কাঠামোতে। তৈরি হবে নেতৃত্ব। বলাবাহুল্য, যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ প্রেসিডেন্ট অঙ্গরাজ্য সরকারের গভর্নরের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে আবির্ভূত হয়েছেন।
বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের কর্মবিভাগের প্রাণ হলো সিভিল সার্ভিস, যা উপসচিব থেকে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত বিন্যস্ত। দেখা যায় যে, একজন বিসিএস পাস করে সিভিল প্রশাসনে নিয়োগপ্রাপ্ত হলেন। এক মন্ত্রণালয় থেকে অন্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু পরিবেশ মন্ত্রণালয় দায়িত্ব পালনের পর তাকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হন না। ফলে কাজে স্থবিরতা নেমে আসে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য যেমন চিকিৎসা পেশা থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়, আইন মন্ত্রণালয়ের জন্য যেমন আইন বিষয়ের ব্যাকগ্রাউন্ডের লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয়, তেমনি অর্থ, বাণিজ্য, শিল্প মন্ত্রণালয়ের জন্য পেশাভিত্তিক প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করা আবশ্যক। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের অধীনে নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবীদের ক্যাডার সার্ভিস হিসেবে অভিহিত করা হয়। ‘ক্যাডার’ শব্দটি সম্মানের নয়। সরকারি কর্মকর্তারা সেবা বা সার্ভিস প্রদানে নিয়োজিত। তাই একে সার্ভিস হিসেবে ব্যবহার হওয়া উচিত।
বর্তমান সংস্কার উদ্যোগে অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়গুলোকেও সম্পৃক্ত করা উচিত। বর্তমানে শিল্প মন্ত্রণালয় রয়েছে। শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান তদারকি এবং শিল্প সংল্ডান্ত পলিসি প্রণয়নের মধ্যে এর কার্যল্ডম সীমাবদ্ধ। আমাদের দরকার এমন মন্ত্রণালয় যা ব্যাপক শিল্পায়নের উন্নয়নে দায়িত্ব পালন করবে। শিল্প উন্নয়নের জন্য জাপানে গরহরংঃৎু ড়ভ ঊপড়হড়সু, ঞৎধফব ধহফ ওহফঁংঃৎু (গঊঞও) রয়েছে। বাংলাদেশ এর আদলে শিল্প উন্নয়নের লক্ষ্যে মন্ত্রণালয় গঠন করতে পারে।
সাবেক শাসকের কবল থেকে সদ্য মুক্ত হওয়া বাংলাদেশে এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা যাতে কেন্দ্রীভূত হতে না পারে সেজন্য রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ এবং নির্বাহী বিভাগের দুটি পদ অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংস্কার উদ্যোগ এক ঐতিহাসিক ঘটনা।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রায় পুরোটাই সংস্কার প্রয়োজন। সংস্কার হতে হবে রাজনৈতিক, শিল্প-বাণিজ্য, সামাজিক, শাসন-প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব, অর্থনৈতিক, ভূমি বন্দোবস্ত, শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রেই। সরকারের কাছে মানুষের বিশাল প্রত্যাশা। বিগত সময়ে অপশাসনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়েছিল বহুমাত্রিক পদ্ধতিতে। জনবান্ধব পলিসি গ্রহণের জন্য উপযুক্ত সময় এখনই। অন্তর্বর্তী সরকার একটি আইনি এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামো করে দেবে। যার আদলে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সরকার পরিচালিত হবে এবং ল্ডমান্বয়ে গড়ে তোলা হবে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ। জনআকাক্সক্ষা পূরণে সুপারিশমালা যোগ্য নেতৃত্বের অধীনে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হোক- সেটাই কাম্য।
লেখক : প্রাক্তন পরিচালক, এফবিসিসিআই, প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট, জাপান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি
[email protected]