ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০ ফাল্গুন ১৪৩১

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যু ও সমকালীন বাস্তবতা

ড. মো. মোরশেদুল আলম

প্রকাশিত: ১৯:৫৮, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যু ও সমকালীন বাস্তবতা

জাতিগত নিধন ও দমন-পীড়নের শিকার হয়ে মিয়ানমার থেকে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। মানবিক দিক বিবেচনায় তাদের আশ্রয় প্রদান করা হলেও এই জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের পরিবেশ, প্রতিবেশ, অর্থনীতিসহ আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নিরাপত্তা হুমকি শুধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্যই নয়, বরং পুরো এশিয়া মহাদেশের নিরাপত্তাসহ বিশ^জুড়ে সংকট তৈরি করবে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘস্থায়ী উপস্থিতি একটি জটিল ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তের বেশিরভাগ অংশই কিন্তু রাখাইন। বর্তমানে রাখাইন আরাকান আর্মির দখলে রয়েছে। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী দেশটির ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিল। জান্তা সরকারের ক্ষমতা দখলের ৪ বছর পূর্তির একদিন আগেই মিয়ানমারে জরুরি অবস্থার মেয়াদ আরও ৬ মাস বৃদ্ধি করেছে। সামরিক বাহিনী অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পর থেকে দেশটিতে কার্যত গৃহযুদ্ধ চলছে। বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী নিজ নিজ এলাকায় নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ৩৫ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা করছে জান্তা সরকার। সফলভাবে সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের জন্য এখনো স্থিতিশীলতা ও শান্তি স্থাপন প্রয়োজন বলে জান্তা কর্তৃপক্ষ মনে করেন। বিরোধীরা এই নির্বাচনকে ‘ভন্ডামি’ বলে অভিহিত করেছেন। এই নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করে তারা বলেছেন, এটি জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত হবে। বিরোধীরা একে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা কুক্ষিত করার অপকৌশল হিসেবেই দেখছেন। তবে মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ সংঘাত সমাপ্ত হলে দেশটিতে একটি পরিবর্তন আসবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংকট সমাধানের কোনো সুযোগ আসবে বলে মনেও হচ্ছে না। তবে রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই ও স্থায়ী সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চাইলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সংকটের প্রতি বিশে^র মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আর্জেন্টিনার ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশন তথা সর্বজনীন বিচার ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়েছিল। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সংঘটিত ব্যাপকভিত্তিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য আন্তর্জাতিক বিচার এবং অপরাধ আদালতে চলমান বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রেও আর্জেন্টিনার অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের ইনডিপেনডেন্ট ইনভেস্টিগেটিভ মেকানিজম ফর মিয়ানমারের (আইআইএমএম) প্রধান নিকোলাস কৌমজিয়ান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আইআইএমএমের কাজের পরিধি মিয়ানমারে শুধু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়ে সীমাবদ্ধ নয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আর্জেন্টিনায় সর্বজনীন বিচার ব্যবস্থা প্রয়োগ করা হয়েছিল। মিয়ানমারে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতা কার্যকর হতে পারে। মিয়ানমারে চলমান অভ্যন্তরীণ সংঘাত, রাখাইন রাজ্য আরাকান আর্মির দখলে নেওয়া এবং বিদ্যমান রোহিঙ্গা সংকট সব মিলিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের প্রতিকূলে। রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবিক সহযোগিতা হ্রাস পাওয়ায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের জন্য আরও বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশে^র অনেক দেশই সহায়তার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে যে অবস্থান নিয়েছে তা পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তুলতে পারে। মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পূর্ণাঙ্গ রোডম্যাপ দিতে হবে। আসিয়ানের সীমাবদ্ধতা থাকলেও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সদস্য রাষ্ট্রগুলো ভূমিকা রাখতে পারে। যদিও আসিয়ান সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না, কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যা এখন আর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়; আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোকেও প্রভাবিত করছে।
মিয়ানমারের রাখাইনে ভারত, চীন, জাপান, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ভূকৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। একদিকে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে চীনবিরোধী জোটের শক্তির মহড়া, অন্যদিকে রাখাইনে পরিবর্তিত ভূকৌশলগত গুরুত্ব প্রভৃতি কারণে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এখন আন্তর্জাতিক এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ জান্তা সরকার বিরোধীদের রাজনীতির দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এসব কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তাছাড়া অপ্রতুল সম্পদ ও নানাবিধ সীমাবদ্ধতা নিয়ে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আশ্রয় দেওয়া বাংলাদেশের পক্ষে অসম্ভব। সীমান্ত এলাকায় চলমান সশস্ত্র সংঘাতের পাশাপাশি রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো মানব পাচার, মাদক চোরাচালান, জঙ্গি কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন অপরাধের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গা সংকটে জর্জরিত বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে বিভিন্ন চেষ্টা করেও মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা এই জনগোষ্ঠীকে এখনো তাদের দেশে ফেরত পাঠাতে পারেনি। এরই মধ্যে বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর মধ্যে চলমান যুদ্ধ অবস্থা নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে বাড়তি প্রায় ৬০ হাজার মানুষের অনুপ্রবেশের ফলে মানবিক পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এতে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকটরূপে ধরা পড়েছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ অবস্থা বিবর্তনের ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবং নতুন করে আরও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ফলে ব্যাপক জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। মিয়ানমার ও রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধ বন্ধে এবং স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রগুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতা দেশগুলোর সহায়তায় রোহিঙ্গাদের রাখাইনে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করতে আরাকান আর্মি, সেখানকার অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও স্থানীয় রাখাইনদের নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। বিশেষ করে মিয়ানমারের দুই বৃহৎ প্রতিবেশী চীন ও ভারতকে আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে, যাতে করে মিয়ানমার জান্তা সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়।
২০২৪ সালের ১০ জুলাই জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের ৫৬তম অধিবেশনে রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানের ওপর একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছিল। গৃহীত প্রস্তাবটিতে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত করা এবং তাদের জোরপূর্বক বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনীতে নিয়োগের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। প্রস্তাবটিতে মিয়ানমারে যুদ্ধরত সকল পক্ষকে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দেওয়াসহ তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়। উক্ত প্রস্তাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যৌন অপরাধসহ সকল প্রকার নির্যাতন, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থায় আনা ও তদন্ত প্রক্রিয়া জোরদার করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ এবং ন্যায়বিচার আদালতে চলমান বিচার প্রক্রিয়াকেও সমর্থন জানানো হয়। গত সেপ্টেম্বর মাসে ৭৯তম জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) সপ্তাহব্যাপী উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ইউএনজিএর তৃতীয় কমিটিতে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। এক বার্তায় বলা হয়, ওআইসি ও ইইউর যৌথভাবে পেশ করা ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্য সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রস্তাবটি ইউএনজিএর তৃতীয় কমিটিতে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। এ বছর অন্য বিষয়গুলোর মধ্যে প্রস্তাবটি অন্যান্য দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা মুসলিমসহ সকল শরণার্থীর প্রত্যাবর্তনের অধিকার নিশ্চিত এবং স্বেচ্ছা, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ টেকসই প্রত্যাবর্তন ও পুনর্মিলনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি তৈরি করতে সহায়ক হতে পারে। এতে হত্যা, ধ্বংস ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, মানবিক সহায়তা প্রবেশে বাধা, শিশুসহ বেসামরিক নাগরিক বিশেষ করে রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্য সংখ্যালঘুদের জোরপূর্বক সশস্ত্র বাহিনী অথবা সশস্ত্র গ্রুপে নিয়োগসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অপরাধের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। প্রস্তাবটিতে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য সমস্ত প্রক্রিয়াকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। প্রস্তাবটিতে একটি আঞ্চলিক সংস্থা হিসেবে আসিয়ানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ওপর জোর দেওয়া হয় এবং সম্পূর্ণভাবে পাঁচ দফার ঐকমত্যের উদ্যোগগুলোকে তুলে ধরা হয়। এদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে উচ্চপর্যায়ের সম্মেলন আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির সাধারণ পরিষদে (ইউএনজিএ) রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার রূপরেখা অনুযায়ী প্রস্তাব প্রণয়নে ২০২৫ সালের মধ্যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনসহ সংকটের টেকসই সমাধানের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট ও সময়োপযোগী পরিকল্পনা প্রস্তাব করার জন্য ওই সম্মেলনের লক্ষ্য হচ্ছে সামগ্রিক সংকট পর্যালোচনা করা।
রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে স্বেচ্ছায় ও নিরাপদ প্রত্যাবাসন ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিতকল্পে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। রোহিঙ্গারা যেন পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করে তাদের নিজ ভূমি রাখাইনে ফেরত যেতে পারে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যকে কেন্দ্র করে ভূরাজনীতি এবং পরাশক্তিগুলোর স্বার্থ বিদ্যমান থাকায় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। রোহিঙ্গা সমস্যার উৎপত্তি যেহেতু মিয়ানমারে, তাই এর সমাধানও মিয়ানমারের নিকট রয়েছে। মিয়ানমার জান্তা সরকার বারবারই অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে। এখন পর্যন্ত মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে সংকট নিরসনে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়নি। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর ধর্মীয় এবং জাতিগত দমন-পীড়ন বন্ধে মিয়ানমার সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করতে হবে। বিশ^বাসী এখন উদ্ভূত নতুন নতুন সংঘাত প্রত্যক্ষ করছে এবং দুর্ভাগ্যবশত রোহিঙ্গা সংকটের রাজনৈতিক সমাধান ও এর ক্রমবর্ধমান মানবিক চাহিদা মেটানো থেকেই বিশে^র মনোযোগ হ্রাস পেয়েছে। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাতসহ বৈশি^ক অন্যান্য সাম্প্রতিক সংঘাতের ডামাডোল এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুটি এখন অনেকটা গৌণ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ২০১৭ সালে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তদারকিতে রোহিঙ্গাদের জন্য একটি নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব প্রদান করেছিল। কিন্তু সে সময় ভারতের অসম্মতির কারণে তা আর আলোর মুখ দেখেনি। রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল কেবল জনগোষ্ঠীটির অনিশ্চিত, অনিরাপদ, আশাহীন জীবনের অবসান ঘটাবে তা নয়, একই সঙ্গে তা বাংলাদেশের এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যও সবচেয়ে বাস্তব ও কার্যকর পদক্ষেপ বলে মনে করি। তবে নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক শক্তি হলো চীন ও ভারত। এই নিরাপদ অঞ্চলের ধারণাটি পশ্চিমা বিশ^ তথা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নিকট স্বীকৃত হতে হবে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক জটিলতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্ত। এই সংকট সমাধানে বহুমুখী কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কোনো বিকল্প নেই। প্রত্যাবাসন নিয়ে চলমান অনিশ্চয়তার ফলে রোহিঙ্গাদের মধ্যে সৃষ্ট হতাশা এবং এর নানাবিধ নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বসবাসের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে টেকসই এবং স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনের কাজ শুরু করা প্রয়োজন। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত বাংলাদেশকে সহযোগিতা করা। মিয়ানমারে শান্তি, নিরাপত্তা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালনের জন্য আসিয়ান এবং অন্যান্য আঞ্চলিক পক্ষকে কাজ করতে হবে। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে বিশ^ব্যাপী জনমত তৈরি হলেও মিয়ানমারের জান্তা সরকার তা আমলে নিচ্ছে না। ঐতিহাসিকভাবেই মিয়ানমার সরকার দেশ থেকে বের করে দেওয়া রোহিঙ্গাদের সে দেশে পুনরায় ঢুকতে না দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক কৌশলগুলো পরিবর্তন করতে হবে। আবার বিশ^বাসী দেখেছে, জাতিসংঘে রোহিঙ্গা বিষয়ক প্রস্তাবে চীন ও রাশিয়া ভেটো প্রদান করে। এরপরও যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়াসহ সকল বৃহৎ শক্তিকে পাশে নিয়েই রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশকে কাজ করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ নতুন বৈশি^ক ও অভ্যন্তরীণ সংঘাতের দিকেই সরে যাচ্ছে, যা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে বিলম্বিত করছে। রোহিঙ্গাদের জন্য নাগরিকত্বের পথ সুগম করাসহ  রাখাইন রাজ্য বিষয়ক কফি আনান উপদেষ্টা কমিশনের সুপারিশসমূহ সম্পূর্ণ বাস্তবায়নে ব্যাপকভিত্তিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের রাজনৈতিক সদিচ্ছাও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ এবং প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নতুন করে ভাবতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব চাইলে যত দ্রুত সম্ভব সকল পক্ষের উপস্থিতিতে একটি সম্মেলনের আয়োজন করতে পারেন। মিয়ানমার জান্তা সরকারের মানবতাবিরোধী অপরাধের অবসান ঘটিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করার জন্য জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংগঠন এবং বিশ^নেতাদের কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
 
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×