
১৯৪৭ সালের অনাকাঙ্ক্ষিত দেশ বিভাগ আপামর জনগণের জন্য কোনো মুক্তির নিশানা দিতে না পারাও ইতিহাসের বিপন্নতা। সদ্য উপনিবেশমুক্ত হওয়া পাকিস্তানি শাসনামল বাঙালির জন্য নিজস্ব সাংস্কৃতিক দ্বার উন্মোচন করতে বরাবরই পিছু হটেছে। তাই ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ যখন উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র ভাষা হিসেবে বিবেচনায় আনলেন তাও জাতির জন্য মঙ্গল হয়নি। তৎকালীন কিছু উদ্দীপ্ত বাঙালি তরুণ ঘোর প্রতিবাদে ভাষার ওপর অযাচিত আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। জনসংখ্যার দিক থেকে বাঙালিরাই এগিয়ে ছিল বিধায় লড়াই করতেও সম্মুখ পানে ছুটে যেতে সময়-সুযোগ কোনোটারই ঘাটতি দৃশ্যমান হয়নি। ভাষা যে কোনো জাতির নিজস্ব বৈভবই শুধু নয় যুগ-যুগান্তরের সাংস্কৃতিক দ্যোতনার পরম নির্মাল্যও বটে। আর বাংলা ছিল উপমহাদেশের এক উর্বরা শক্তির সম্পদশালী দেশ। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন উর্বর পলিমাটির বাংলায় বীজ মাত্রই নাকি সোনা ফলে। অতীতে বহু কিংবদন্তির এমন ধনাঢ্য অঞ্চলের স্বাধীনচেতা মনোবৃত্তিও ছিল এক পরম উদ্দীপ্ত চেতনায় আবিষ্ট-নিবিষ্ট যাই বলা হোক না কেন, ইংরেজ উপনিবেশবাদের আগে বহু রাজবংশের ভাঙা গড়ার মাঝেও বাংলা ছিল এক অপরাজেয় অষ্ট্রিক জাতি গোষ্ঠীর বংশ পরম্পরায় নির্ভীক, লড়াকুর যে দুঃসাহসিক ধারা তাও এই পলিমাটির বাংলার দুর্জয় শক্তি।
সেই বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানি শাসনামলে সাংস্কৃতিক নিপীড়নের দুরবস্থায় পড়ে তাও ইতিহাসের আর এক নব অধ্যায়। রাষ্ট্রযন্ত্রের পালাক্রমে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ থেকে মুক্ত স্বাধীন পাকিস্তান যখন বাঙালির সাংস্কৃতিক বৈভবকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় তেমন দুঃসময়ে লড়াকু এই বাঙালি রাজপথে নেমে আসতেও সময় নেয়নি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ কত না কাঠখড় পুড়েছে বাংলার ঐতিহাসিক বলয়কে সুরক্ষিত রাখতে। তেমন দুরন্ত দাবানলে ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারির রাজপথ রক্তে রাঙানো এক লাল মিছিলে রূপ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। তৎকালীন শাসক গোষ্ঠী অস্ত্র চালোনায়ও বাংলার দামাল ছেলেদের দমাতে পারেনি। জীবনের পরোয়া না করে যে মাত্রায় তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর সম্মুখ সমরে নিজেদের মূল্যবান প্রাণকেও তুচ্ছ করতে পেছন ফিরে তাকায়নি পর্যন্ত। যা আজ যুগ-যুগান্তরের ইতিহাসের বরমাল্য। লাগাতার ৭৩ বছরের সীমানা অতিক্রম করা এই ভাষা সংগ্রাম আজ অবধি বাঙালির রক্ত ঝরা ঐতিহ্যের অনন্য লড়াকু যাত্রা পথ। তাই ২১ ফেব্রুয়ারি এলে নতুন করে ভেতর থেকে উদ্দীপ্ত প্রেরণায় মাতৃভাষাকে যেন চিরস্থায়ী শৌর্যের আবরণে মুড়িয়ে রাখে। একুশ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন শাসক গোষ্ঠীর ১৪৪ ধারার কণ্টকাকীর্ণ পথকে দুমড়ে-মুচড়ে যে গৌরবান্বিত যাত্রাপথ সেটা লাল সবুজের পতাকার আর এক রক্তের প্লাবন। অবিস্মরণীয় এমন ঐতিহ্যিক বলয় যেন কয়েক যুগের যাত্রাপথের মায়ের ভাষার জন্য পরম আকুতি ভরা এক স্বর্গীয় দেশাত্মবোধের চিরন্তন বেদনার নিঃসৃত বাতাবরণ। ১৯৫২ সাল। ধারাবাহিক প্রতিবাদে উদ্দীপ্ত, লড়াকু বাঙালির এক ঐতিহ্যিক, দেশজ সাংস্কৃতিক বৈভবের পরম দিকনির্দেশন। উল্টো দিকে শাসক শ্রেণিও ছিল মরিয়া। বাংলার মাটিতেই উদ্দীপ্ত জোয়ানদের লড়াকু অভিগমনে যে সাঁড়াশি রক্তাক্ত আক্রমণ তাতে লুটিয়ে পড়ে কয়েক বাঙালি সংগ্রামী যোদ্ধা। সালাম, বরকত, রফিক, জাব্বার পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ছোড়া গুলিতে রক্তবিধৌত রাজপথে লুটিয়ে পড়েন। ভাষার জন্য এমন লড়াই আর আত্মাহুতি বিশ্বের অন্য কোনো দেশ দিয়েছে কি না তাও অজানা। তাই বাংলা ইতিহাসেই নয়, বিশ্ব ঐতিহাসিক দলিলে ভাষার জন্য রক্তে মাখানো রাজপথ আর দৃশ্যমান না হওয়াও ২১ ফেব্রুয়ারির আর এক কাঁটা বিছানো পাথর ছড়ানো পথ। তেমন জরাজীর্ণ দুঃসাহসিক যাত্রা আজও বাঙালিদের মাতৃভাষার উদ্দীপ্ত চেতনায় ভরিয়ে তোলে। পরিপূর্ণ করে দেয়। ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ সেøাগানে ঢাকার রাজপথ উত্তাল হলে শাসক গোষ্ঠীও চুপ থাকেনি। শাসক শ্রেণির উন্মত্ত আস্ফালনে সেদিন বাংলার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত, দেশের সবুজ প্রান্তর লোহিত সাগরে নিমজ্জিত হওয়ার দুরবস্থায়। তার পরও দুর্বার মনোশক্তিও অন্তরের নিভৃতে জিইয়ে থাকা স্বজাত্যবোধের পরম অহঙ্কার আর অলঙ্কারে বীর বাঙালিকে সম্মুখ লড়াইকে আলিঙ্গন করতে পেছন ফিরে মোটেও তাকাতে হয়ইনি।
তার দাম চুকাতে হয়েছে বহু ভাষা সংগ্রামীর মূল্যবান জীবনের আতাহুতির দাবানলে। অবিস্মরণীয় এক ঐতিহাসিক রক্তে রঞ্জিত পিচ্ছিল অভিযাত্রা। যা আজও আবহমান বাংলার লড়াকু ইতিবৃত্তের এক অপরাজেয় শক্তিমত্তা। মাতৃভাষা আর মায়ের মমতাঘন স্নেহাতিশয্য বাংলার উর্বর পলিমাটির মায়াভরা প্রতিবেশ সব মিলিয়ে সোনার বাংলার আকাশ-বাতাস যে মধুর সংগীতের মূর্ছনায় জনগোষ্ঠীর জীবন বৈচিত্র্যের যে অপরূপ মহিমার আবির ছড়ায় সেটা যেন চিরস্থায়ী এক নন্দন কানন। তাই যেমন মাতৃভূমি তেমন মাতৃভাষায় মিলন শৌর্য আবহমান বাংলা বাঙালির প্রতিদিনের যাপিত জীবনের মূল্যবোধ, সংস্কৃতি তার নিত্য কর্ম প্রবাহ সবই যেন বিনি সুতোর মামলায় গাঁথা। ১৯৫২ সালের পর থেকে প্রতি বছর একুশ ফেব্রুয়ারি আসে তার সর্ববিধ আবেদন, নিবেদন আর ঐক্যতানের নির্মল বাঁধনে। যা অবিচ্ছিন্নভাবে যুগ-যুগান্তরের মিলনগ্রন্থি। ৭৩ বছরের যাত্রাপথ অতিক্রম করে যে সার্বজনীন বাঙালির মনন বোধকে অবিমিশ্র দ্যোতনায় পূর্ণ থেকে পূর্ণতর করে চলছে। ভাষা কোনো জাতির জন্মগত অধিকারই শুধু নয় আজন্ম লালিত স্বপ্নের মূল সোপানে গ্র্রথিত, বিকশিত। যা প্রত্যেক মানুষের জাতিগত স্বাপ্নিক চিরস্থায়ী বৈভবই শুধু নয় নিত্য যাপিত জীবনের পরম অনুষঙ্গ আর অনুপ্রেরণাও বটে। তাই ২১ ফেব্রুয়ারি একটি দিন বা শোকাবহ ঘটনাপঞ্জি নয়। চিরায়ত বাংলা ও বাঙালির পরম নির্মাল্যের সাংস্কৃতিক দ্যোতনায় সিদ্ধ, পরিশুদ্ধ। হাল্কা করে দেখার কোনো সুযোগই নেই। কোনো দিবসে আটকে রাখাও চিরস্থায়ী মাহাত্ম্যকে ক্ষুণ্ন করা। তাই একুশের চেতনা নিত্য জীবন বোধ অনন্তকালের সাংস্কৃতিক বরমাল্য আর ঐতিহাসিক পরম্পরার চিরস্থায়ী মিলন।