ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৯ ফাল্গুন ১৪৩১

ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা

মো. মাসুদ চৌধুরী

প্রকাশিত: ২০:২৯, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়, যা পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এবং পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমান পাকিস্তান) অংশে বিভক্ত ছিল। সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৪ কোটি, যা পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৮ শতাংশ এবং পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলত। এ ছাড়াও বাংলা ছিল সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী ভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তান ছিল পাকিস্তানের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। তাই অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও গণতান্ত্রিক কারণে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ২৩ নভেম্বর করাচিতে একটি শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করা হয়, যা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য ছিল অপমানজনক। তাই ১৯৪৭ সালের ১ অক্টোবর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এ এফ এম নূরুল হক ভূঁইয়ার নেতৃত্বে প্রথম ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। এর কয়েক মাস পরে বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষা, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থ আদায়, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ (বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ)। যা পরবর্তী সময়ে ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৯৫৫ সালের ১৯ আগস্ট পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগরাকে সরিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। ২১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ রাখে, যা ছিল বাঙালিদের স্বাধিকার আন্দোলনের বিপরীতে কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিফলন। এর প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। একই বছর, পাকিস্তানের গণপরিষদ নতুন সংবিধান তৈরির কাজ শুরু করে এবং বাংলা ভাষার স্বীকৃতি, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতার বিতর্ক শুরু হয়। এই সময় বাঙালি জনগণের ভাষাগত অধিকার রক্ষায় আন্দোলন তীব্র হয়। অবশেষে ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১৪(১) পুনর্লিখিত হয়, যাতে বলা হয় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং বাংলা।’ এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যার মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের বিজয় এবং জাতীয় ঐক্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলা ভাষার প্রতি বৈষম্য এরপরও অব্যাহত ছিল। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পাকিস্তানে সামরিক শাসন ঘোষণা করেন এবং নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
১৯৬২ সালে আইয়ুব খান নতুন সংবিধান প্রণয়ন (প্রেসিডেনসিয়াল শাসন ব্যবস্থা) করেন, যেখানে  উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হলেও বাংলা ভাষার মর্যাদা নিয়ে কোনো কথা ছিল না। তাই ১৯৬২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান উর্দু ও বাংলা ভাষার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আরও সক্রিয় হন। ১৯৬৫ সালে কাশ্মীর ইস্যু এবং রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। যা শেষ হয় আন্তর্জাতিক চাপে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ১৯৬৬ সালের জানুয়ারিতে তাসকন্দ চুক্তির মাধ্যমে। যুদ্ধের পর পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি এবং পূর্ব পাকিস্তানের আমদানি-রপ্তানিতে বাধা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানিদের মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের দাবি প্রবল হয়ে ওঠে। ফলে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। এটি পাকিস্তান সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে। কারণ এই আন্দোলন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করে। ফলে ১৯৬৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরও কয়েক নেতার বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ মামলায় ১৯৬৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার হন এবং তাকে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি করা হয়। এতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সহযোগীদের ব্যাপক জনগণের সমর্থন লাভ করে। তাই ১৯৬৮ সালে আবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ ৩৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। ১৯৬৮ সালের শেষে এবং ১৯৬৯ সালের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নেতৃত্বে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবসহ অন্যদের মুক্তির দাবিসহ ১১ দফা দাবি উত্থাপন করে, যা মূলত ছয় দফার সম্প্রসারিত রূপ। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদুজ্জামান (আসাদ) ও ২৪ জানুয়ারি মতিউর রহমান পুলিশের গুলিতে এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি বিচারাধীন অবস্থায় কারাগারে সার্জেন্ট জহুরুল হক নিহত হন। যা জনমনে আরও ক্ষোভ সৃষ্টি করে এবং পূর্ব পাকিস্তানে প্রবল বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্র ও গণ-আন্দোলনের চাপে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সহযোগীদের মুক্তি দেওয়া হয়। আন্দোলনের ফলে পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান চরম চাপে পড়েন। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খান ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারি করে নতুন সরকার গঠন করেন। ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দেন।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সংসদের মোট ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসন পেয়ে জয়ী হয়। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোর দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি মাত্র ৮১টি আসন পায়। কিন্তু ভুট্টো ঘোষণা করেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ নির্বাচিত করলেও পশ্চিম পাকিস্তান মেনে নেবে না।’ ইয়াহিয়া ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকেন। কিন্তু ১ মার্চ তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে তৎকালীন ডাকসুর ভিপি আ স ম আব্দুর রব প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এরপর ৩ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করে। ৫ মার্চ ঢাকায় হরতাল পালিত হয় এবং পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে কয়েকজন নিহত হন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ভাষণে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ৭ মার্চের ভাষণের পর পুরো পূর্ব পাকিস্তানে কার্যত শেখ মুজিবের নির্দেশে চলতে থাকে। ১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা আসেন এবং শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। তবে মূলত এটি ছিল প্রতারণা। ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত আলোচনা চললেও ইয়াহিয়া গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা ইপিআর ক্যাম্পসহ বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ চালানোর আগের রাতে শেখ মুজিবকে তার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। প্রাথমিকভাবে বিক্ষিপ্ত প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। তবে পরে এটি সুসংগঠিত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন এবং বাংলাদেশকে মুক্ত করতে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেন। ১০ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়, যা পরে মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিতি পায়। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার (রাষ্ট্রপতি : শেখ মুজিবুর রহমান (কারাগারে থাকায় নামমাত্র রাষ্ট্রপতি) অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি : সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী : তাজউদ্দীন আহমদ, সেনাপ্রধান : এম এ জি ওসমানী) আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। (তথ্যসূত্র : সংবাদপত্র ও অনলাইন)
ভাষা আন্দোলন ছিল বাংলা ভাষা এবং বাঙালি জাতির অধিকার রক্ষায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম বৃহৎ প্রতিবাদ। এই আন্দোলন ছিল বাঙালির সাহস, সংগ্রাম ও ঐক্যের প্রথম পরীক্ষা। যার মাধ্যমে বাংলাভাষী জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতা এবং বাংলাদেশের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর টঘঊঝঈঙ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ২০০০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী দিনটি ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও বহুভাষিক সংস্কৃতির গুরুত্ব বোঝাতে পালিত হয়ে আসছে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

×