ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৯ ফাল্গুন ১৪৩১

মাতৃভাষায় ডিজিটাল কনটেন্ট

ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার

প্রকাশিত: ২০:২৬, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

মাতৃভাষায় ডিজিটাল কনটেন্ট

কনটেন্ট কথাটির বাংলা প্রতিশব্দ হলো বিষয়বস্তু, যা কোনো নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর ওপর তথ্য ও উপাত্তের সমষ্টি। আর ডিজিটাল কনটেন্ট হলো ডিজিটাল ডেটার আকারেবিদ্যমানযেকোনো কনটেন্ট। ডিজিটাল বিষয়বস্তু নির্দিষ্ট ফরম্যাটে ডিজিটাল মিডিয়া বা এনালগ যে কোনো পদ্ধতিতেই ডিজিটাল কনটেন্ট সংরক্ষিত হতে পারে। পরে এগুলো বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস যেমন কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, ট্যাবলেট ইত্যাদির মাধ্যমে বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে ডাউনলোড, সংরক্ষণ এবং শেয়ার করা যায়। এগুলো হলো লিখিত তথ্য, ছবি, শব্দ কিংবা ভিডিও ইত্যাদি যা ডিজিটাল ডিভাইসে দেখা যায় এবং শিক্ষা, বিনোদন, যোগাযোগ এবং বিপণনে বেশ সহায়তাযোগ্য। এগুলোকে ই-কনটেন্টও বলা হয়, যা উৎপাদন, বিকাশ, পুনর্ব্যবহার এবং প্রচারযোগ্য। ইলেকট্রনিক উপাদান, যার মধ্যে পাঠ্য, ছবি, গ্রাফিক্স, অ্যানিমেশন, অডিও এবং ভিডিও রয়েছে, তাকে ই-কনটেন্ট হিসেবে উল্লেখ করা হয়। যে কোনো ডকুমেন্ট ফাইল, প্রেজেন্টেশন ফাইল, অডিও ফাইল বা ভিডিও ফাইলকে ই-কনটেন্ট বলে। ই-কনটেন্টগুলো অধ্যয়নের উপাদান বা বক্তৃতা, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রকল্প, পরীক্ষার প্রশ্ন, প্রশ্ন-উত্তর ব্যাংক, অনুশীলন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিছু জনপ্রিয় এবং কার্যকরী কনটেন্ট মাধ্যম হলোÑ সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম : ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার এবং লিঙ্কডইনের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো বিভিন্ন ধরনের কনটেন্ট যেমন ছবি, ভিডিও এবং টেক্সট পোস্ট শেয়ার করার জন্য উপযুক্ত। ব্লগ : ব্লগগুলো গভীর কনটেন্ট তৈরি, ঝঊঙ উন্নত করা এবং নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য চমৎকার। এটি ওয়েবসাইটে ট্রাফিক নিয়ে আসতেও সাহায্য করে। ভিডিও প্ল্যাটফর্ম : ইউটিউব এবং টিকটক ভিডিও কন্টেন্টের জন্য শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম, যা টিউটোরিয়াল, বিনোদন বা ব্র্যান্ড স্টোরিটেলিংয়ের জন্য উপযুক্ত। অডিও কনটেন্ট : পডকাস্ট, অডিও ক্লিপ এবং সঙ্গীত অন্তর্ভুক্ত। পডকাস্ট দীর্ঘমেয়াদি কনটেন্ট এবং এমন অডিয়েন্স পৌঁছানোর জন্য আদর্শ যারা অডিও কনটেন্ট পছন্দ করে। ইন্টারেক্টিভ কনটেন্ট : কুইজ, পোল, ইন্টারেক্টিভ ইনফোগ্রাফিক এবং অন্যান্য ইন্টারেক্টিভ উপকরণ। ইমেল নিউজলেটার : ইমেল ব্যক্তিগত যোগাযোগের জন্য কার্যকরী, সাবস্ক্রাইবারদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে এবং তাদের ইনবক্সে মূল্যবান কনটেন্ট শেয়ার করতে সহায়ক।  টেক্সট কনটেন্ট : এর মধ্যে আর্টিকেল, ব্লগ পোস্ট, ই-বুক, হোয়াইটপেপার এবং রিপোর্ট অন্তর্ভুক্ত। ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট : এতে ছবি, ইনফোগ্রাফিক, মিম এবং ইলাস্ট্রেশন অন্তর্ভুক্ত। ডিজিটাল কন্টেন্টের প্রধান সুবিধাগুলো হলো- ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন তথ্য, বিনোদন এবং শিক্ষামূলক উপাদানের ব্যাপক সংগ্রহ প্রদান করে। সরাসরি অ্যাক্সেসের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা যে কোনো সময়, যে কোনো জায়গায় ডিজিটাল কনটেন্ট চেক করতে পারেন। সংগ্রহ, সংশোধন এবং বিতরণে সহজতার উপায় প্রদান করে সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক বা আর্থিক ক্ষতি কমায় এবং প্রয়োজনে প্রাক্তন ব্যয় এবং জমা করে সমর্থিত করে। অর্থাৎ প্রথাগত মিডিয়া তুলনায় উৎপাদন এবং বিতরণ খরচ কম। আরও উল্লেখযোগ্য সুবিধাগুলো হলোÑ বৃহত্তর পৌঁছানো : ডিজিটাল কনটেন্ট দ্রুত এবং দক্ষতার সঙ্গে বিশ্বব্যাপী একটি বৃহৎ দর্শকের কাছে পৌঁছাতে পারে। সহজ আপডেট : কনটেন্টটি সহজেই আপডেট বা পরিবর্তন করা যায় রিয়েল-টাইমে। অ্যানালিটিক্স : সম্পৃক্ততা এবং কার্যকারিতা ট্র্যাক করতে বিস্তারিত অ্যানালিটিক্স এবং পারফরমেন্স মেট্রিকস প্রদান করে।
সুবিধার পাশাপাশি সুবিধাও আছে অনেক। যেমনÑ ১. মানসম্পন্ন সমস্যার মাধ্যমে অসত্য বা ভুল তথ্যের সম্মুখীন হওয়া সম্ভব। ২. সাইবার নিরাপত্তা সমস্যার সম্মুখীন হওয়া সম্ভব, যেমনÑ হ্যাকিং, অনধিকৃত অ্যাক্সেস, অনুপযুক্ত ব্যবহার ইত্যাদি। ৩. ডিজিটাল কনটেন্ট ব্যবহার করার জন্য উচ্চতর স্পেশালাইজড প্রয়োগ ও প্রয়োগের দরকার হয়, যা অন্য ব্যাক্তিদের উপলভ্য নয়। ৪. স্বাধীনতার অভাবের কারণে ডিজিটাল কনটেন্টের উপভোগে সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, যেমন ইন্টারনেট সংযোগের অভাব বা আর্থিক সমস্যার জন্য। ৫. বিক্রেতার আধিক্য : ডিজিটাল স্পেসে প্রচুর কনটেন্ট থাকায় প্রতিযোগিতার মধ্যে টিকে থাকা কঠিন হতে পারে। ৬. নিরাপত্তা ঝুঁকি : ডিজিটাল কনটেন্ট হ্যাকিং, ডাটা ব্রিচ এবং অননুমোদিত প্রবেশের মতো সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে। ৭. কালচারাল ডাইভারসিটি : প্রযুক্তির স্বরূপে সমাহিত হওয়া বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কারণে প্রচলিত ও ব্যক্তিগত ইচ্ছা আকাক্সক্ষা কিংবা সামঞ্জস্য কমে যেতে পারে।
৮. প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা : প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেটের অ্যাক্সেসের প্রয়োজন, যা সব সম্ভাব্য ব্যবহারকারীর জন্য উপলব্ধ নাও হতে পারে। ৯. স্বল্প মনোযোগকাল : অনলাইন ব্যবহারকারীদের মনোযোগের সময়সীমা সাধারণত সংক্ষিপ্ত থাকে, যা দীর্ঘ কনটেন্টের সঙ্গে তাদের যুক্ত করা কঠিন হতে পারে। ১০. কনটেন্ট অতিরিক্ততা : অনলাইনে প্রচুর পরিমাণে কনটেন্ট উপলব্ধ থাকায় ব্যবহারকারীরা বিভ্রান্ত হতে পারে অথবা কনটেন্ট ক্লান্তির শিকার হতে পারে। ১১. রক্ষণাবেক্ষণ : নিয়মিত আপডেট এবং রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন হয় কনটেন্টের কার্যকারিতা বজায় রাখতে, যা অনেক সময় সম্ভব হয় না। ১২. তথ্য নিরাপত্তা : ডিজিটাল তথ্য নিরাপত্তা সম্পর্কে সংক্ষেপে বিশেষ সচেতনতা থাকতে হয়। হ্যাকিং, ভাইরাস এবং অন্যান্য সাইবার আক্রমণের ঝুঁকি থাকতে পারে। ১৩. যোগাযোগের অসুবিধা : টেকনোলজির নিয়মিত আপডেট হওয়া থাকতে পারে এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ বা সুস্থতায় ব্যবহার করতে অসমর্থ ব্যবহারকারীদের জন্য এটি কাঠিন্য সৃষ্টি করতে পারে। ১৪.কাজের লোড : ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার সম্মতি থাকতে পারে কিন্তু এটি কাজের লোড বৃদ্ধি করে এবং কিছুটা ক্রিয়াশীলতা হারাতে পারে।
ডিজিটাল যুগ শুরু হওয়ায় সবকিছু দ্রুত পরিবর্তন হয়ে গেছে এবং হচ্ছে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন আপডেট ডিভাইস তৈরি হচ্ছে। এগুলো জীবনের জন্য যেমন অনেক সুবিধা বয়ে আনছে, তেমনি এর কিছু ক্ষতির দিকও থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের উচিত সচেতন হয়ে সবকিছু ব্যবহার করা। কারণ বর্তমানে আমরা প্রায় সবাই ডিজিটাল ডিভাইসের ওপর অনেকাংশ নির্ভরশীল। এগুলো এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে। লেখাপড়া, ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও আরও নানা বিষয়ে আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে ডিজিটাল কনটেন্ট। যেমনÑ আমরা যখন অনলাইনে কোনো বিল পরিশোধ করি তখন রিসিট হিসেবে ডিজিটাল কনটেন্ট সংরক্ষণ করে থাকি। এ ছাড়াও ইন্টারনেটে জমির খতিয়ানও এখন জিডিটাল কনটেন্ট হিসেবে ডাউনলোড করা যায়। অন্যান্য ইউটিলিটি বিল যেমন বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের বিল সবই হচ্ছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ডিজিটাল কনটেন্টের সহায়তায়। বিকাশ, ইউক্যাশ, নগদ এমনকি ব্যাংকিং কিছু লেনদেনে ডিজিটাল কনটেন্ট থাকায় তা সকল শ্রেণির মানুষের জন্য সহজবোধ্য ও ব্যবহারযোগ্য হচ্ছে। মাতৃভাষায় কনটেন্ট থাকায় এগুলোর জনপ্রিয়তা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে যে কোনো তথ্যকেই একটি সফল কনটেন্ট হিসেবে ধরে নেওয়া যায় না। কনটেন্ট হতে হবে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর শতভাগ নির্ভুল ও প্রয়োজনীয় তথ্যে সমৃদ্ধ। যাতে যে বিষয়ের ওপর কনটেন্ট তৈরি করা হয় সেই বিষয় সম্পর্কে ব্যবহারকারী পুরোপুরি ধারণা পায়।
একটি সফল কনটেন্ট যে কোনো প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ একটি মূলধন। সেজন্য একটি কনটেন্টে যত বেশি তথ্যসংযুক্ত করা যাবে কনটেন্টটি তত বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে এবং জনপ্রিয়তা পাবে। শিক্ষা, ব্যবসা, বিনোদন কিংবা অন্য যে কোনো কাজে সফলতা অর্জনের জন্য একটি ভালো মানের কনটেন্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল কনটেন্ট শিক্ষাক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা। ডিজিটাল কনটেন্টের মাধ্যমে শিক্ষাদান পদ্ধতি শিক্ষার ক্ষেত্রে এক নবদিগন্তের সূচনা করেছে। অর্থাৎ পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে একাধিক স্লাইডের সাহায্যে যে কোনো মূর্ত-বিমূর্ত বিষয়ে অতি সহজেই শিক্ষার্থীদের পাঠদান সম্ভব হয়। এই পাঠদান শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেমন আনন্দদায়ক, তেমনি সহজবোধ্য। সনাতন চক, ডাস্টার, চকবোর্ড দিয়ে শিক্ষার্থীদের অনেক তত্ত্বগত ধারণা যথাযথভাবে দেওয়া অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। কিন্তু ডিজিটাল কনটেন্টের মাধ্যমে একাধিক স্থির বা চলমান চিত্রের সাহায্যে শিক্ষার্থীদের যে কোনো বিষয়ে পূর্ণ ধারণা দেওয়া আনন্দদায়ক। ব্যবসার ক্ষেত্রেও অনুরূপ। অনলাইন বিজনেসকে একটু একটু করে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে ভালো মানের কনটেন্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই শিক্ষা, বাণিজ্য, বিনোদনসহ সর্বক্ষেত্রে মাতৃভাষায় ভালো মানের ভিডিও, টেক্সট বা অন্য যে কোনো কনটেন্ট তৈরি করা হোক একুশের অঙ্গীকার।

লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

×