ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৯ ফাল্গুন ১৪৩১

ভাষা শহীদ আবুল বরকত: দুই বাংলার দুই প্রান্তে স্মৃতির সন্ধানে

ড. জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশিত: ১৯:৩৪, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ভাষা শহীদ আবুল বরকত: দুই বাংলার দুই প্রান্তে স্মৃতির সন্ধানে

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে শহীদ আবুল বরকত এক অবিস্মরণীয় নাম। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি আদায়ের লড়াইয়ে তিনি প্রাণ উৎসর্গ করেন। ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা আজ মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার পেয়েছি।

তবে আবুল বরকতের পরিচিতি শুধু বাংলাদেশের গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তার জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বাবলা গ্রামে। অথচ, তার জীবনাবসান ঘটে বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজপথে, যেখানে তিনি মাতৃভাষার জন্য নিজের বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন।

আমার গবেষণার সুবাদে আমি দীর্ঘদিন ভারতের বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম। তখন থেকেই ভাবনা আসত, যে মানুষটি ভাষার জন্য শহীদ হলেন, তার জন্মস্থান কেমন ছিল? এই ভাবনার তাগিদেই ২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, আমি রওনা হই মুর্শিদাবাদের বাবলা গ্রামে, আবুল বরকতের শৈশবের স্মৃতি খুঁজতে।

ঠিক তিন বছর পর, ২০২৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, আমি গিয়েছিলাম ঢাকায় অবস্থিত ভাষা শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালা দেখতে। একই ব্যক্তির স্মৃতিকে দুই দেশে খুঁজে পাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল এক অনন্য অনুভূতি, যেন এক অদ্ভুত নস্টালজিক যাত্রা।

প্রথম গন্তব্য: ভাষা শহীদের জন্মভূমি—বাবলা গ্রাম, মুর্শিদাবাদ (ভারত)
২০২২ সালের এক শীতের সকালে আমি পৌঁছাই মুর্শিদাবাদের বাবলা গ্রামে, যেখানে আবুল বরকতের জন্ম। মুর্শিদাবাদ একসময় নবাবদের রাজধানী ছিল, কিন্তু এই গ্রামটির গর্ব এক ভিন্ন কারণে। এখানে জন্মেছিলেন সেই মহান ভাষা সৈনিক, যার রক্ত ঢাকার রাজপথে ঝরেছিল বাংলা ভাষার মর্যাদার জন্য।

গ্রামে ঢুকতেই এক অনন্য অনুভূতি হলো। এখানকার মানুষজন গর্বের সঙ্গে জানান, “আমাদের গ্রাম থেকে এক শহীদ জন্মেছিলেন, যিনি বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন।” তবে আশ্চর্যের বিষয়, বরকতের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য তেমন কোনো বড় উদ্যোগ নেই। শুধুমাত্র একটি স্মৃতিফলক রয়েছে, যা স্থানীয়দের উদ্যোগে তৈরি হয়েছে।

গ্রামের এক প্রবীণ ব্যক্তি আমাকে জানান, বরকতের পরিবার একসময় এখানেই বসবাস করত, কিন্তু দেশভাগের পর তারা বাংলাদেশে চলে যান। বরকতের নাম এই অঞ্চলে পরিচিত হলেও, সরকারিভাবে তার স্মৃতি সংরক্ষণে খুব বেশি উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

এই উপলব্ধি আমাকে খানিকটা ব্যথিত করল। এত বড় আত্মত্যাগের স্মৃতিচিহ্ন যদি গ্রামবাসীদের উদ্যোগেই সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তা সত্যিই দুঃখজনক। তবে স্থানীয়দের মুখে বরকতের গল্প শোনা, তার শৈশবের পথঘাটে হাঁটা—এই অভিজ্ঞতা আমাকে ইতিহাসের আরও কাছে নিয়ে গেল।

দ্বিতীয় গন্তব্য: ভাষা শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (বাংলাদেশ)
২০২৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, আমি গিয়েছিলাম ঢাকার ভাষা শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালা দেখতে। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের পাশে অবস্থিত, যেখানে বরকত পড়াশোনা করতেন।

জাদুঘরে প্রবেশের পরই এক অন্যরকম অনুভূতি হলো। এখানে বরকতের জীবন, ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়, ২১ ফেব্রুয়ারির সেই ভয়াবহ দিন এবং ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের কাহিনি চিত্রিত করা হয়েছে।

জাদুঘরে রাখা রয়েছে ভাষা আন্দোলনের সময়কার সংবাদপত্রের কাটিং, বরকতের ব্যক্তিগত কিছু নিদর্শন, তার পরিবারের স্মৃতিচারণ এবং ভাষা আন্দোলনের স্থিরচিত্র। একটি দেয়ালে বড় পর্দায় একুশের গান বাজছিল, যা আমাকে আরও আবেগপ্রবণ করে তুলল।

ঢাকার এই সংগ্রহশালায় বরকতের স্মৃতি যথাযথভাবে সংরক্ষিত হয়েছে। এখানে তিনি শুধু একটি নাম নন, তিনি এক বীর, এক চেতনা। দেশের জন্য, ভাষার জন্য তার আত্মত্যাগ যথাযথ সম্মান পেয়েছে। কিন্তু এখানে এসে মনে হলো, তার জন্মভূমির গল্প যেন হারিয়ে গেছে।

দুই বাংলায় দুই প্রান্তের বরকতের স্মৃতি: অনুভূতির তুলনা
বাবলা গ্রামে বরকতের শৈশব কেটেছে, কিন্তু তার স্মৃতি সংরক্ষণের অভাব রয়েছে। স্থানীয়দের মনে তার জন্য ভালোবাসা থাকলেও, সরকারিভাবে তেমন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এখানকার বাতাসে তার শেকড়ের গন্ধ পাওয়া যায়, কিন্তু ইতিহাসের আলোচনায় তার জন্মস্থান প্রায় হারিয়ে গেছে।

অন্যদিকে, ঢাকার সংগ্রহশালায় বরকতের আত্মত্যাগ যথাযথভাবে সংরক্ষিত হয়েছে। তার ব্যবহৃত কিছু নিদর্শন, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও শহীদদের কাহিনি এখানে সংরক্ষিত আছে। এখানে বরকতের নাম ইতিহাসের পাতায় সোনার অক্ষরে লেখা, কিন্তু তার শৈশবের গল্প তেমনভাবে উঠে আসেনি।

বরকত দুই বাংলার এক ইতিহাস
ভাষা শহীদ আবুল বরকত কেবল বাংলাদেশের নন, তিনি দুই বাংলারই সন্তান। ভারতের বাবলা গ্রাম তাকে জন্ম দিয়েছে, আর বাংলাদেশ তাকে বীর শহীদতে পরিণত করেছে। কিন্তু দু’দেশে তার স্মৃতি সংরক্ষণের মাঝে এক বড় পার্থক্য রয়েছে।

আমি যখন বাবলা গ্রামে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন অনুভব করছিলাম এক ত্যাগী সন্তানের শেকড়কে। আর যখন ঢাকার স্মৃতি জাদুঘরে ছিলাম, তখন দেখছিলাম সেই শেকড় থেকে জন্ম নেওয়া এক অমর কিংবদন্তির গল্প।

আজকের তরুণ প্রজন্মের কাছে এই ইতিহাস তুলে ধরা প্রয়োজন। দুই দেশকেই উদ্যোগ নিতে হবে, যেন বরকতের শেকড় ও আত্মত্যাগ একসঙ্গে সংরক্ষিত হয়। ভাষার জন্য তার আত্মত্যাগ যেন কেবল স্মৃতির পাতায় বন্দী না থাকে, বরং নতুন প্রজন্মের চেতনায় প্রোথিত হয়।

এম.কে.

×