
মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ সমতুল্য। শিশুর পুষ্টি, বিকাশ ও বর্দ্ধনায় যেমন মাতৃদুগ্ধের বিকল্প নেই তেমনি নিজ নিজ মাতৃভাষা ব্যতিরেক সন্তানের পরিপূর্ণ শিক্ষা লাভ হয় না। তাই বোধশক্তি উন্মীলনের সময়কাল থেকে শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য মাতৃভাষায় অর্থাৎ মায়ের ভাষায় সংযুক্ত রাখতে হবে। অনেক মা-বাবাই শিশুকে ইংরেজি শিক্ষায় পারদর্শী করতে বাংলা ভাষার ওপর কম গুরুত্বারোপ করেন। এতে বাংলা ভাষায় তারা দুর্বল হতে পারে এবং মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধেও কমতি দেখা দিতে পারে। এটা পরে শিশুর নৈতিক শিক্ষার ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলা ভাষা বাঙালির অস্তিত্বের স্মারক। মানবজীবনে ভাষার ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে ভাষা না হলে নেশান বা জাতি গঠিত হয় না এবং ভাষা সম্বন্ধে সচেতন না হলে জাতীয়তাবোধও আসে না। হৃদয়ের অন্তঃস্থলে আজন্মলালিত সেই প্রাণের ভাষার সম্মানরক্ষার তাগিদেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সালারের বাবলা গ্রামের বরকতের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন বেলডাঙার কাজিশাহ গ্রামের সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়েরই অধ্যাপক আনোয়ার পাশা। এ ছাড়াও বিশিষ্ট অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, সন্তোষ ভট্টাচার্য প্রমুখও শামিল হয়েছিলেন ভাষা আন্দোলনের তুমুল জোয়ারে। অমূল্য প্রাণ বলিদান করেছিলেন শুধু মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার টানে। বহু নারীও রক্ষণশীলতার বন্ধন ছিন্ন করে ভাষা আন্দোলনের জন্য পথে বেরিয়ে এসেছিলেন। যেমন নারায়ণগঞ্জের একটি স্কুলের প্রধানশিক্ষিকা মমতাজ বেগম। কারাবন্দি অবস্থায় মুচলেকার বিনিময়ে তাঁকে মুক্তির প্রস্তাব দিয়েছিল স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু তিনি তাতে রাজি না হওয়ায় স্বামী তাঁকে তালাক দেন। বেগম সুফিয়া কামালকে বাংলা ভাষাপ্রীতির জন্য অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। যার কণ্ঠে প্রথম ধ্বনিত হয়েছিল ভাষাবৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, পঁচাশি বছর বয়সে সেই ধীরেন্দ্রনাথ এবং তাঁর ছোট ছেলে দিলীপ দত্তকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করা হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি অশ্রুসিক্ত ইতিহাস প্রতি বছর বাঙালি মননে স্মরণ করিয়ে দেয় মাতৃভাষার প্রতি নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ। বাংলা ভাষা আমাদের সুদীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্য বহন করে। মাতৃভাষা প্রথম শেখার মধ্য দিয়ে ওই ইতিহাস, ঐতিহ্যের সঙ্গে শিশু একাত্ম হতে পারে। তাই বাঙালি শিশুদের প্রথম পাঠ হওয়া উচিত বাংলায়। ঠিক সেভাবেই প্রত্যেক শিশুর প্রথম পাঠ হওয়া উচিত তার মাতৃভাষায়। অনেক অভিভাবকই মনে করে থাকেন, ইংরেজি ভাষাটা কঠিন আর সেটিই প্রথমে শেখাতে হবে। কিন্তু এটা ভুল ধারণা। ভাষা তো শুধু ভাষা নয়, এর মধ্যে থাকে শব্দ, ভাবাবেগ, দ্যোতনা ও মনের ভাব প্রকাশের নানা উপায়। আর সেগুলোর মধ্য দিয়ে একজন মানুষ আত্মপ্রকাশ করতে পারে। বিদেশী ভাষায় দীক্ষিত করতে চাওয়াটা অবশ্যই দোষের নয়। তবে বাংলা ভাষায় শিক্ষা নেওয়ার পর যে কোনো ভাষায় পারদর্শী হতে পারে। মায়ের মুখনিঃসৃত ভাষাই হলো প্রত্যেক মানবশিশুর প্রথম পাঠ। মানুষের সব অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে যেমন মা, ঠিক তেমনই মিশে আছে মায়ের কাছে শেখা মায়ের মুখের মধুর ভাষা মাতৃভাষা। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষালাভ করা প্রত্যেক শিশুর জন্মগত অধিকার। মাতৃভাষার মতো সহজসাধ্য ভাষাও নেই। তাই যা সহজসাধ্য, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সেটিকে গ্রহণ করাই নিঃসন্দেহে শ্রেয়। বাংলাই হোক আমাদের চিন্তা-চেতনা, দুঃখ-বেদনা, আনন্দ-উল্লাস প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম। ভাষার সঙ্গে যেহেতু নিজ দেশের সংস্কৃতির সংমিশ্রণ থাকে, সেহেতু আমরা আমাদের মাতৃভাষা প্রথমে শিখব।
বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম থেকে