
বিষয়টি অবাক করার মতো। মানুষ ব্যাকরণ ছাড়াই মাতৃভাষা শিখে। বাংলাভাষী মায়ের সন্তান ইংরেজি বা ভিন্ন কোনো ভাষায় কথা বলতে শেখে না। মা যে ভাষায় কথা বলেন কোলের শিশু সেই ভাষাতেই কথা বলতে শেখে। প্রত্যেক মানুষের কাছে তার সবচেয়ে প্রিয় ভাষা হলো মাতৃভাষা। মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় উত্তমরূপে নিজের ভাব প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। অমৃত সুধায় ভরা মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা সম্পর্কে কবির ভাষায় বলা যায় ‘মধুর চেয়েও আছে মধুর, সে যে আমার মাতৃভাষা। মায়ের সঙ্গে যেমন সন্তানের নাড়ির টান ঠিক তেমনই টান মাতৃভাষার সঙ্গে মানুষের। মানুষের অস্তিত্বের প্রধান তিনটি অবলম্বনই হচ্ছে মা, মাতৃভাষা আর মাতৃভূমি। আমরা মাকে ভালোবাসি। ভালোবাসি মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকে। যখন ১৯৫২ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আমাদের ওপর উর্দু চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল তখন বাংলা মায়ের সন্তানেরা মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য জীবনের মায়া ত্যাগ করে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। বাংলার মানুষ জুলুম, অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করেছিল। রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত, শফিউরসহ নাম না জানা অনেকেই শহীদ হয়েছিলেন। বিশ্বের বুকে একমাত্র আমরাই সেই বীরের জাতি যারা মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলাম। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্য বাংলাদেশের মানুষের অভূতপূর্ব আত্মত্যাগের স্বীকৃতি হিসেবে ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে।
কিন্তু তিক্ত হলেও সত্য যে, ৭৫ শতাংশ বাঙালি শুদ্ধরূপে বাংলা বলতে, লিখতে ও পড়তে পারে না। ভুল উচ্চারণে কবিতা আবৃত্তি করে, প্রবন্ধ পাঠ করে। ভুল বানান লেখে। অনার্স, মাস্টার্স পাস করা লোকজনও ভুল বানান লেখে। ভাষা নিয়ে আমাদের আবেগের কমতি নেই, কিন্তু ভাষা নিয়ে পরিশ্রম করতে আমরা রাজি নই। বর্তমানে বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার অনেক সমৃদ্ধ। বাংলা একাডেমির ২৪টিরও বেশি অভিধান আছে। আমরা দেখতে পাই অনেকেই আধুনিকতার নাম করে কিংবা উচ্চশিক্ষিতের ভাব ধরে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল কিংবা এফএম এর আর্জেদের অনুসরণ করে ভিন্ন ভিন্ন ভাষার তালিপট্টি লাগিয়ে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে কথা বলে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড ইংরেজিতে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এটা স্ববিরোধী কাজ। বিকৃত ভাষা বাঙালির প্রত্যাশিত নয়। সর্বত্র মাতৃভাষার চর্চা বাড়াতে হবে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাধ্যতামূলক বাংলা পড়াতে হবে। মাতৃভাষার শুদ্ধ উচ্চারণ ও শুদ্ধ বানানের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসার নামই নিজের মাকে ভালোবাসা, নিজের দেশকে ভালোবাসা। একুশ এলেই কেবল বাংলা ভাষার কদর বাড়ে। শহীদ মিনারে ম্যাওম্যাও করা বক্তব্য আর পচাদুর্গন্ধময় বাণী শোনায়। পত্রিকায় ছবি আসে, সেলফিগিরি করে এইতো একুশ। একুশ চলে গেলেই সব ভুলে যায়। এ হলো লোক দেখানো বাংলাকে ভালোবাসা। আসুন সত্যিকারের বাঙালি হই। মা, মাতৃভাষা এবং মাতৃভূমিকে ভালোবাসি।
তাড়াইল, কিশোরগঞ্জ থেকে