
ভিন দেশে অন্যের বুলিতে আপন মনোভাব প্রকাশ করার মতো যন্ত্রণা বোধ করি পৃথিবীতে কমই আছে। সে সময় বুঝা যায়, মাতৃভাষার কদর কতটুকু। তখনই মনের মন্দিরে পূজার আসনে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার আর কত জানা অজানা ভাষাসৈনিকদের নাম আসীন হয় ভক্তি সহকারে।
আমি তরুণ, বয়স সবে মাত্র ২৫ এর কোঠায় পা রেখেছি। এতশত না বুঝলেও এটা ভালো করেই বুঝি, একুশে ফেব্রুয়ারির আগমনে মনের আপন আলয়ে কিছু উথাল পাথাল আরম্ভ হয়। তখনই অনুভব করি, দেশমাতৃকার প্রতি নিজের সকল ঘাটতি।
আত্মসমালোচনা করেই নর উদ্যমে নব্য তারুণ্য শক্তিকে আন্দোলিত করে চলি দেশমাতৃকার সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের প্রত্যাশায়।
একটু পিছনের গল্পে তাকাই। ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে দেশ বিভক্তির কথা যখন নিশ্চিত হয়, তখন মে মাসে চৌধুরী খালিকুজ্জামান এবং জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলে সর্বপ্রথম প্রবন্ধ লিখে প্রতিবাদ করেছিলেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং ড. মো. এনামুল হকসহ কয়েকজন সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী।
২১ ফেব্রুয়ারি ও ২২ ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা এবং ২৪ তারিখে পুলিশ কর্তৃক শহীদ মিনার ভেঙে ফেলার প্রতিবাদে একুশের চেতনাকে লালন করে বহু সাহিত্যিক অনেক গল্প, নাটক, কবিতা রচনা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া কোনো একক ঘটনা নিয়ে আর তত বেশি কবিতা, গল্প লেখা হয়নি।
একুশের কবিতা গভীরভাবে জনগণকে যতটুকু আলোড়িত করেছিল, অন্য কোনো বিষয় তা পারেনি। মাহবুব আলম চৌধুরীর দীর্ঘ কবিতা, ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ একুশের চেতনাকে নিয়ে রচিত অন্যতম কবিতা।
এসব কবিতায় ক্রোধ, ক্ষোভ, ঘৃণা ও প্রতিশোধের বাণী ধ্বনিত হয়েছে। হাসান হাফিজুর রহমানের ‘একুশের ফেব্রুয়ারি’ সংকলনে মুদ্রিত হয়েছে বহু কবিতা। কবিতার প্রতিটি শব্দ উত্তাল করেছিল বিবেককে।
বায়ান্ন সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহীদের রক্ত যেখানে ঝরেছিল সেখানে গড়ে উঠেছিল স্মৃতিস্তম্ভ। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক তা ভেঙে দেওয়া তরুণ কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ পুলিশ কর্তৃক শহীদ মিনার ভাঙ্গার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন।
প্রতিবাদ, ঘৃণা কাজ করার প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকবাল হলে (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) বসে রচনা করেন ‘স্মৃতির মিনার’ কবিতাটি। তাৎক্ষণিক আলাউদ্দিন আজাদ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ‘স্মৃতির কিনার ভেঙে সে তোমার ভয় কি বন্ধু আমরা এখনো চার কোটি পরিবার খাড়া রয়েছি তো।’
আবদুল গাফফার চৌধুরীর কবিতা ‘আমার ভাইয়ের রক্তের রাঙানো’ শীর্ষক কবিতাটি পরবর্তী সময়ে একুশের জনপ্রিয় গান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। একুশে ফেব্রুয়ারিকে নিয়ে রচিত হয়েছে বহু নাটক ও কথাসাহিত্য।
ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় থাকার অপরাধে রাজবন্দি হিসেবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারগারে বন্দি ছিলেন মুনীর চৌধুরী। এমনই এক সময়ে তার কাছে একটি চিঠি লিখেন রাজবন্দি রণেশ দাশগুপ্ত। অসাধারণ এক প্রস্তাব ছিল সেই চিঠিতে।
প্রথম শহীদ দিবস উদ্যাপন মুনীর চৌধুরীকে একটি নাটক লেখার অনুরোধ করেছিলেন তিনি। মুনীর চৌধুরী লিখলেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম এক কালজয়ী নাটক, নাম দেওয়া হলো ‘কবর’।
নাটকটির সমগ্র ঘটনাস্থল ছিল গোরস্তান, ভাষা শহীদদের লাশ গুম করার নীলনক্সা বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের জন্য ছিলেন ইন্সপেক্টর হাফিজ। নাটকের শুরু থেকেই অসৎ নেতাকে মদ্যপানে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়।
সুযোগ পেয়ে লোভী হাফিজও নেতার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শেষ চিহ্নটুকু ধামাচাপা দেওয়ার জন্য নানা ধরনের পরিকল্পনা করতে থাকেন তারা। সবকিছু যখন পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোচ্ছিল, তখনই মুর্দা ফকির নামক এক চরিত্রের আগমন ঘটে।
আধপাগল এই মানুষটি যেন সমাজের বিবেক হিসেবে আবির্ভূত হন। লাশগুলো এখনো জীবিত আর তাদের কবর থেকে উঠিয়ে তিনি মিছিল করবেন এমন অদ্ভুত একটি কথা বলে তাদের ভড়কে দেন মুর্দা ফকির।
এরপর কিছু অস্বাভাবিক ঘটনার আবর্তনে এগিয়ে গেছে সম্পূর্ণ গল্প। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী এদেশের মানুষের ভাষা সংস্কৃতিকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল।
কথা সাহিত্যেও একুশের ঘটনা স্থান পেয়েছে। রচিত হয়েছে বহু গল্প-উপন্যাস। শওকত ওসমানের ‘মৌন নয়’ গল্পে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট প্রতিফলিত হয়েছে। তাছাড়া আনিসুজ্জামানের ‘দৃষ্টি’, আতোয়ার রহমানের ‘অগ্নিবাক’ অন্যতম একুশের গল্প।
উপন্যাস হিসেবে জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’, শওকত ওসমানের ‘আর্তনাদ’, সেলিনা হোসেনের ‘যাপিত জীবন’ অন্যতম।
মূলত একুশের ঘটনা বাঙালির নিজের দেখা অভিজ্ঞতার ঘটনা। এ অভিজ্ঞতা বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব বহন করেছে।
একুশ আমাদের প্রাণ। এ নিয়ে রচিত সাহিত্য আমাদের মনে অনুপ্রেরণা জোগায়। আমাদের মনে শক্তি জোগায়। আমাদের উদীপ্ত করে। প্রতিবাদী করে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার প্রেরণা সৃষ্টি করে।
তাই একুশের প্রসূত সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা আমাদের জাতীয় জীবনে অনস্বীকার্য। মূলত বাংলাদেশের সাহিত্যের যাত্রা একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে। এই একুশে ফেব্রুয়ারির পর থেকেই বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মানুষের জীবন প্রণালি উন্মোচিত হয়েছে।
পরবর্তী সময়ের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের সাহিত্যকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। এবার আসি ভাষাসৈনিক ও তারুণ্যশক্তির প্রসঙ্গে। ভাষাসৈনিকরা যখন দেখতে পেলেন মাতৃভাষার প্রতি কাপুরুষদের জঘন্যতম হানা, তখনই তারা তাদের মাঝে লুকায়িত শক্তি টগবগ করতে শুরু করল।
আর এ তারুণ্যশক্তি আমাদের মতো ভবিষ্যৎ তরুণ প্রজন্মের কথা ভেবে জীবনের পরোয়া না করে যথাযথভাবে প্রয়োগ করল পাকিস্তান সরকারের ১৪৪ ধারা জারির বিরুদ্ধে । কতটুকু ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসা থাকলে এমনটা করা সম্ভব তা নিশ্চয়ই আমরা ভালো করেই আন্দাজ করতে পারছি।
ভাষাসৈনিক ও ভাষা শহীদরা আবারও প্রমাণ করে গেলেন তারুণ্যের শক্তির সামনে পৃথিবীর সকল অপশক্তি বৃথা। এই তারুণ্য শক্তিকে যথাযথভাবে ব্যবহার করলে যেকোনো অসাধ্যকে সাধন করা সম্ভব।
এখন প্রশ্ন, সেই ভাষা শহীদদের উত্তরসূরি হলেও আমাদের মাঝে তারুণ্যশক্তি কেন আন্দোলিত হয় না। আমাদের মাঝে কিসের অভাব? আমরা উত্তরসূরি হিসাবে একই দেশে বসবাস করি, তাদের মাতৃভাষায় কথা বলি।
তাহলে আমাদের মাঝে কিসের কমতি? উত্তরটা অবশ্যই আমাদের মাঝে বাঙালি সংস্কৃতিকে লালন করার অভাব। আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে যথাযথভাবে লালন করতে পারি না। মনে রাখতে হবে, ভাষাসৈনিকরা যদি তরুণ বয়সে তারুণ্যশক্তিকে এমনভাবে জাগিয়ে তুলতে পারে, তাহলে আমরাও দেশমাতৃকার টানে তরুণ বয়সে এসে সকল প্রকার দুর্নীতি অবিচার অত্যাচারের বিরুদ্ধে জেগে উঠতে পারব।
আমাদের শুধু দরকার বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা। আর ভাষা সংস্কৃতির একটি উপাদান।
ভিন দেশের সংস্কৃতিকে লালন করা, তাদের লাইফ স্টাইল অনুসরণ করা, বাংলা বাক্যে ইংরেজি শব্দের আধিক্য একজন বাঙালির সঙ্গে এসব বেমানান। আমাদের রক্তে বইছে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের রক্ত। আমরা কিভাবে তাঁদের এ রক্তকে বৃথা যেতে দেব।
আমরা কি জানি না স্বজন হারা বেদনা কেমন? আমরা কি জানি না, মৃত্যুক্ষণে আসা সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের আমাদের মতো আগামী তরুণ প্রজন্ম নিয়ে তাঁদের ভাবনা কি ছিল?
তাদের জীবন উৎসর্গ সার্থক। তাই আমরা নিজ মাতৃভাষা কথা বলতে পারছি। মায়ের কাছ থেকে শেখা ভাষাকে ছড়িয়ে দিচ্ছি সকল প্রান্তে। ভাষা শহীদ ও ভাষা সৈনিকদের জীবন সার্থক। এখন আমাদের উচিত, বাংলা ভাষার মানমর্যাদা রক্ষা করা।
ভাষাসৈনিকদের তারুণ্যশক্তিকে আমাদের মাঝে লালন করা। সকল প্রকার দুর্নীতি অবিচার অন্যায় ধূলিসাৎ হোক এই মাসে। কেননা একুশ বাঙালি তারুণ্যের অহংকার। আজীবন স্মৃতিতে থাকুক ভাষা আন্দোলনের যোদ্ধারা।
লেখক : সংস্কৃতিকর্মী
কুতুবে রব্বানী