ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৮ ফাল্গুন ১৪৩১

ফিলিস্তিন সংকট

ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বৈত ভূমিকা

খন্দকার আপন হোসাইন

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বৈত ভূমিকা

ডোনাল্ড ট্রাম্প

ফিলিস্তিন সংকট মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ফিলিস্তিনিরা চরম বিপর্যয়ের শিকার। তাদের ভূমি দখল, মানবিক অধিকার লঙ্ঘন এবং বাস্তুচ্যুতির ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই সংকটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সবসময় বিতর্কিত। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তথাকথিত ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি বা শতাব্দীর চুক্তি’ এ সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে, যা ফিলিস্তিনিদের জন্য নতুন বিপদের সূচনা করেছে।

সাবেক বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় এসেও সেই ভুল পথেই হেঁটেছে। অবশ্য তাদের ভাষা ছিল আরও কৌশলী ও কঠোর। ফিলিস্তিন সংকটে ট্রাম্প প্রশাসনের ভুল পদক্ষেপ, বাইডেন প্রশাসনের নীরব সমর্থন এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার নীরব দর্শক সবাই। অঞ্চলগত এই বিরোধ আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং বৈশ্বিক শক্তির স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা হিসাব-নিকাশের কেন্দ্রবিন্দু।

ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর এই সংকট নতুন মোড় নিতে যাচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইলকে সমর্থন দেওয়া হলেও ট্রাম্পের সময়ে এর ব্যাপকতা ও প্রকৃতি ভিন্ন মাত্রা পায়। একদিকে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলেন, অন্যদিকে তার বিভিন্ন পদক্ষেপ ফিলিস্তিনিদের অধিকারের বিপরীতে গিয়েছে।
ফিলিস্তিন সংকটের শিকড় অনেক গভীরে। এটি শুরু হয় ১৯১৭ সালে ব্রিটিশদের ঘোষিত ‘ব্যালফোর ডিক্লারেশন’-এর মাধ্যমে। ইহুদি জনগণের জন্য একটি ‘জাতীয় আবাসভূমি’ তৈরির প্রতিশ্রুতি ছিল ব্যালফোর ঘোষণায়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে ফিলিস্তিনি জনগণ ব্যাপক উচ্ছেদের শিকার হন। ১৯৪৮ সালের নাকবা বিপর্যয় ছিল ফিলিস্তিনিদের জীবনে এক চরম দুঃসহ অধ্যায়।

ইসরাইল প্রতিষ্ঠার সময় প্রায় ৭ লাখ ফিলিস্তিনি তাদের জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হন। সেই থেকে শুরু হয় ফিলিস্তিনিদের শরণার্থী জীবন। আজও তাদের অধিকার বাস্তবায়ন হয়নি। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরাইল পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা, পূর্ব জেরুজালেম এবং গোলান মালভূমি দখল করে নেয়। এরপর থেকে প্রতিনিয়ত দখলদারিত্ব, সামরিক অভিযান এবং ইসরাইলের বসতি স্থাপন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
২০১৭ সালে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি এবং মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তরের মাধ্যমে মার্কিন কূটনীতি সুস্পষ্ট হয়। এ সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র সমালোচিত হয়। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ এটিকে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করে।

মুসলিম, ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত জেরুজালেকে একতরফাভাবে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলে। ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার তথাকথিত ‘মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা’ ঘোষণা করেন। ঘোষণাটি ‘শতাব্দীর চুক্তি’ নামে পরিচিতি পায়। মূলত এটি ছিল একটি পক্ষপাতদুষ্ট পরিকল্পনা। ইসরাইলের দখলদারিত্বকে বৈধতা দিয়ে ফিলিস্তিনিদের অধিকার পুরোপুরি অস্বীকার করার পরিকল্পনাও বলা যায়।

ট্রাম্প প্রশাসনের পরিকল্পনার কিছু প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল পশ্চিম তীরে ইসরাইলি বসতি স্থাপনকে বৈধ ঘোষণা করা। জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। গোলান মালভূমির দখলকে বৈধতা দেওয়া। দুই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ  সমাধান ব্যাহত করা। ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ফিরে আসার অধিকার অস্বীকার করা। এই পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘ সনদের স্পষ্ট লঙ্ঘন। ট্রাম্প সরাসরি ফিলিস্তিনিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের দাবি নাকচ করেন। তিনি দাবি করেন, ‘ফিলিস্তিনিদের উন্নয়নের জন্য গাজা ও পশ্চিম তীর ইসরাইলের অধীনে থাকা উচিত।’
বিশ্বব্যাপী মুসলিম নেতাদের বিশ্বাস ছিল, জো বাইডেন ক্ষমতায় এলে ট্রাম্পের ভুল নীতিগুলো সংশোধন হবে। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। বাইডেন প্রশাসন কিছু প্রতিশ্রুতি দিলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো বড় পরিবর্তন হয়নি। বরং বাইডেন প্রশাসন ইসরাইলের প্রতি নীরব সমর্থন জানিয়েছে। বিশেষ করে ২০২১ সালে গাজায় ইসরাইলি হামলার সময় বাইডেন প্রশাসন জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আটকে দেয়।

এটি ইসরাইলের আগ্রাসনকে আরও উসকে দেয়। আবার ট্রাম্প প্রশাসন আর্থিক সহায়তা হ্রাসের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিওএ-তে মার্কিন সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এটি লাখো শরণার্থীর জীবনযাত্রা সংকটে ফেলে দেয়। অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করার এই কৌশল মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতাকে আরও নাজুক করেছে।

তবে ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে ইসরাইল ও কয়েকটি আরব দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চুক্তি যেমন- ‘আব্রাহাম চুক্তি’ মধ্যপ্রাচ্যে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে। ফলে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো এবং সুদান ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। ট্রাম্প প্রশাসন এই ঘটনাকে ঐতিহাসিক সাফল্য হিসেবে উপস্থাপন করলেও বাস্তবে এটি ফিলিস্তিন সংকট সমাধানের পথ আরও জটিল করেছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের এই দ্বৈত ভূমিকা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির পরিবর্তে সংঘাতের ক্ষেত্রকে আরও বিস্তৃত করেছে। একদিকে ইসরাইলের স্বার্থরক্ষার জন্য সরাসরি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে শান্তির কথা বলে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের প্রশ্নকে আড়াল করার চেষ্টা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য নতুন সংকট তৈরি করেছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে যে, আসলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা কতটা বাস্তব। ফিলিস্তিন সংকটে ইসরাইল বরাবরই আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা করেনি। পশ্চিম তীর এবং গাজায় সামরিক অভিযান, বসতি স্থাপন এবং অবরোধ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। জাতিসংঘ এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, গাজায় ইসরাইলের স্থল অভিযানে ৪৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। প্রায় ৭৮ হাজার মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছেন।

বিভিন্ন স্কুল, হাসপাতাল এবং পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইসরাইলের এই কর্মকা-কে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ বলে আখ্যা দিয়েছে। বিখ্যাত সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক একবার লিখেছিলেন, ‘ফিলিস্তিনিদের প্রতিদিনই হত্যা করা হচ্ছে কিন্তু বিশ্ব দেখেও নীরব।’
দুই রাষ্ট্রের স্থায়ী সমাধান বহু বছর ধরে আলোচিত। তবে ইসরাইলের দখলদারিত্ব এবং মার্কিন প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্ট নীতির কারণে এই সমাধান আজ প্রায় অবাস্তব। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একাধিকবার ঘোষণা দিয়েছেন যে, তিনি ফিলিস্তিনকে কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন না। তার এই বক্তব্য দুই রাষ্ট্র সমাধানের সম্ভাবনাকে আরও কঠিন করে তুলেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির পেছনে রয়েছে ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ। ইসরাইলকে সমর্থন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তার আধিপত্য বজায় রাখতে চায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, মার্কিন-ইসরাইল কৌশলগত মিত্রতা অস্ত্র ব্যবসা এবং তেল ব্যবসার সঙ্গেও সম্পর্কিত।
ফিলিস্তিন সংকট সমাধান না হলে মধ্যপ্রাচ্যে কখনো শান্তি আসবে না। মার্কিন প্রশাসনের একপেশে নীতি এবং ইসরাইলের আগ্রাসী দখলদারিত্ব ফিলিস্তিনিদের জন্য প্রতিনিয়ত নতুন সংকট তৈরি করছে। ট্রাম্প প্রশাসনের  দ্বৈত ভূমিকা কেবল এই সংকট সমাধানে বাধা হয়েই দাঁড়ায়নি, বরং বিশ্বরাজনীতিতে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।

ট্রাম্পের ভুল নীতি এবং বাইডেন প্রশাসনের নীরব সমর্থন এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন। তাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও মানবিক অধিকারের জন্য বিশ্ববাসীর একসঙ্গে এগিয়ে আসা জরুরি। ফিলিস্তিন সংকট একটি মানবিক সংকট, একটি মানবিক বিপর্যয়, একটি মানবিক দুর্দশা।

বহুল আলোচিত এ সংকট সমাধানের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গত পদক্ষেপ প্রয়োজন। পক্ষপাতমূলক কূটনীতি ও রাজনৈতিক স্বার্থের খেলায় ঘনীভূত এই সংকট যত দ্রুত সম্ভব দূর করতে হবে।

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক 

[email protected]

×