
অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের লড়াই
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর একটি ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। দায়িত্ব গ্রহণের পর গত ৬ মাসে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এতে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরেছে, থেমেছে রিজার্ভের পতন। কিন্তু দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে রাজস্ব আয়ে ঘাটতি, বিদেশী বিনিয়োগে স্থবিরতা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়া।
শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কমে যাওয়ায় উৎপাদন খাতেও চলছে স্থবিরতা। বৈদেশিক ঋণ প্রত্যাশিত হারে আসছে না, অথচ সুদ পরিশোধের ব্যয় বেড়েছে। এতে নিয়মিত সরকারি কার্যক্রম ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে। ব্যাংক খাতে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে, তবে তারল্যসংকট ও বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা কাটেনি।
তাছাড়াও জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা ও নিহতদের পরিবারের পুনর্বাসন কর্মকা-ে গতিহীনতা, দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র, প্রশাসনে অস্থিরতা, দাবি-দাওয়া নিয়ে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের লাগাতার আন্দোলন, শিক্ষাঙ্গনে একের পর এক অস্থিরতা, নির্বাচনের দাবিতে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্রমাগত চাপ, সর্বোপরি আওয়ামী লীগের রেখে যাওয়া ভঙ্গুর অর্থনীতি সামাল দিয়ে চলতে হচ্ছে সরকারকে। এতে একদিকে যেমন অনেক কাজের জন্য সরকার সমাদৃত হচ্ছে, তেমনি সমালোচনাও পিছু ছাড়েনি। সব মিলিয়ে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পার হয়েছে বর্তমান সরকারের ছয় মাস।
অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, এক- বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে দেশে ১ হাজার ৫৯৬ কোটি ১৮ লাখ মার্কিন ডলার রেমিটেন্স এসেছে। গত বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৯১ কোটি ২৮ লাখ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে রেমিটেন্সের প্রবাহ বেড়েছে ৩০৫ কোটি ডলার।
এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে ২১৮ কোটি ৫২ লাখ মার্কিন ডলার পাঠিয়েছেন। যা গত বছরের জানুয়ারিতে ছিল ২১১ কোটি ৩১ লাখ ডলার। অর্থাৎ ২০২৪ সালের জানুয়ারির তুলনায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে রেমিটেন্স ৩ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। রপ্তানি ও রেমিটেন্সের প্রবৃদ্ধির কারণে দেশে ডলারের প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা কিছুটা কমিয়েছে।
এই বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস রিজার্ভও বেড়েছে। চলতি বছর জানুয়ারিতে গ্রস রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলারে, যা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ছিল ১৯ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার। দুইÑ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৫৮ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। যা গত অর্থবছর একই সময়ে ছিল ১ লাখ ৬৫ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে রাজস্ব আয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা কমেছে, যা ৬ শতাংশের সমান। রাজস্ব কর্মকর্তাদের মতে গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হয়েছে। যার ফলে রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এখন পর্যন্ত আদায় হয়েছে মাত্র ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ।
এটি সরকারের জন্য আরও বেশি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিন- বিপুল রাজস্ব ঘাটতির কারণে সরকারকে ব্যাংক থেকে নতুন ঋণ নিতে হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরকারের নিট ব্যাংক ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে সরকার ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ গ্রহণ করেনি। বরং এই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে ৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করেছে, যা আগে নেওয়া হয়েছিল।
চার- ব্যাংক থেকে সরকার বেশি ঋণ নেওয়ায় বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বেশিরভাগ সময়েই বেসরকারি খাতে কমেছে ঋণের প্রবৃদ্ধি। চলতি অর্থবছরেও একই ধারা বহাল রয়েছে। এই অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এই হার গত সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ। গত বছরের একই সময়ে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশের ওপরে। সংকোচনমূলক নীতি বজায় রাখার ধারায় চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে এই লক্ষ্যমাত্রা ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল।
পাঁচ- কমেছে বিনিয়োগ, জিডিপিতে প্রভাব নতুন বিনিয়োগের সঙ্গে জড়িত মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি। কিন্তু গত ছয় মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি বাড়েনি, উল্টো কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ৮৭৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার মূল্যমানের এলসি খোলা হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১ হাজার ২৮৫ কোটি ডলার। সেই হিসাবে এলসি খোলার হার কমেছে ৩২ শতাংশ।
এতে প্রভাব পড়েছে শিল্পোৎপাদন, দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ও কর্মসংস্থানে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১ দশমিক ৮১ শতাংশ, যা গত বছর একই সময়ে ছিল ৬.০৪ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) নিট এফডিআই এসেছে মাত্র ১০ কোটি ৪৩ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩৫ কোটি ৭২ লাখ ডলার।
সে হিসাবে এফডিআই কমেছে ২৫ কোটি ২৯ লাখ ডলার বা ৭১ শতাংশ। বিডার তথ্যমতে ২০২৪ সালে ৭৪২টি প্রকল্পে ১,১৬৩ কোটি ডলারের বিনিয়োগ নিবন্ধন হলেও রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সরকার পরিবর্তনের কারণে বিনিয়োগের প্রবাহে ধস নেমেছে।
২০২৩ সালের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ২৫৪টি প্রকল্পে ৬৬৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার বিনিয়োগ হয়েছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে তা কমে মাত্র ১৮৬টি প্রকল্পে ১৮৬ কোটি ৭১ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ বিনিয়োগ কমেছে ৪৮০ কোটি ৯ লাখ ডলার বা প্রায় ৭২ শতাংশ। ছয়Ñ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) প্রকল্প পরিকল্পনায় ধীরগতি, অর্থছাড়ে বিলম্ব এবং লোকবল নিয়োগে দেরিসহ নানা কারণে দেশে এই সংকট নিয়মিতই দেখা যাচ্ছে।
তবে চলতি বছর এতে বাড়তি সংযোজন ঘটেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ১৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে এই হার ছিল ২২ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এর মধ্য দিয়ে ২০১২-১৩ অর্থবছরের পর প্রথমবারের মতো এডিপি বাস্তবায়নের হার ২০ শতাংশের নিচে নেমেছে। সাতÑ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে বিদেশী ঋণের প্রতিশ্রুতি ছিল ২২৯ কোটি ৮৬ লাখ ডলার, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৬৯৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার।
অর্থাৎ প্রতিশ্রুতি কমেছে প্রায় ৪৭০ কোটি ডলার বা ৬৭ শতাংশ। এছাড়া অর্থছাড়ও কমেছে এই ৬ মাসে ৩৫৩ কোটি ২৪ লাখ ডলার, যা গত বছর ছিল ৪০৬ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। অর্থাৎ অর্থছাড় কমেছে ১৩ শতাংশ। তবে প্রতিশ্রুতি ও অর্থছাড় কমলেও ঋণের সুদ পরিশোধের চাপ বেড়েছে। এই সময়ে সরকারকে ৭৪ কোটি ৭৫ লাখ ডলার সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৬৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার।
আট- ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ছয়টি কমিশন গঠনের কথা জানান প্রধান উপদেষ্টা। কমিশনগুলো হলোÑ নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার, বিচার বিভাগ সংস্কার, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার, জনপ্রশাসন সংস্কার ও সংবিধান সংস্কার কমিশন। এসব কমিশনের মাধ্যমে রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা চূড়ান্ত করার ঘোষণা দেন তিনি। পরে আরও ৫টি কমিশন গঠন করা হয়।
রাজনৈতিক দলগুলো রাজি থাকলে রোজার মধ্যেও সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন ও সুপারিশগুলো নিয়ে আলোচনা চলবে। তবে এসব প্রক্রিয়া অর্থনীতির ক্ষেত্রে কতটুকু সহায়ক হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। নয়Ñ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো কিছু ক্ষেত্রে অপরিবর্তিত, আবার কিছু ক্ষেত্রে আরও গভীর হয়েছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতি তীব্র আকার ধারণ করেছে। দামও সহনশীলতার সীমা ছাড়িয়েছে।
উৎপাদন ও পরিবহন খরচ ক্রমেই বাড়ছে। ডলারের ঘাটতি ও বিনিময় হারে অস্থিরতা কাটেনি। নীতিগত সুদহার বৃদ্ধির ফলে ঋণের সুদ বেড়েছে, যা বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ সংকুচিত করেছে। ফলে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দশÑ ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে আইনশৃঙ্খলা ও ব্যবসা উপযোগী পরিবেশের বিরাট ঘাটতি ও আস্থার সংকট দৃশ্যমান।
তাই প্রবৃদ্ধির খাত গার্মেন্টস থেকে শুরু করে সব ধরনের শিল্প, কৃষি, সেবা, পর্যটনসহ সর্বত্র এখন হতাশার ছাপ স্পষ্ট। ব্যাংক ঋণের সুদহার ৯ থেকে বেড়ে ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এর সঙ্গে আরও বহুমাত্রিক সংকট যোগ হয়েছে। এতে বেশিরভাগ শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন সক্ষমতার তুলনায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। এসবের নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে অর্থনীতির প্রতিটি খাতে। কমছে মোট দেশজ উৎপাদন।
ক্ষয় হচ্ছে অর্থনীতি। বর্তমান সামাজিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ব্যবসার অনুকূলে নয়। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ সব ব্যবসায়ীই এর প্রভাব অনুভব করছেন। এর সঙ্গে আর্থিক খাতের সংকট বিনিয়োগের পরিবেশ আরও কঠিন করে তুলছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, কিন্তু মজুরি বাড়ছে ধীরগতিতে। ফলে মানুষের সঞ্চয় কমছে, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
ওপরে উল্লিখিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সমস্যাগুলো থেকে বেরিয়ে আসার উপায় হিসেবে অর্থনীতিবিদগণ বলেন, সরকার ভঙ্গুর অর্থনীতির দায়িত্ব নিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বেশকিছু পদক্ষেপ নিলেও এখনো কাক্সিক্ষত স্থিতিশীলতা আসেনি। বরং বহুমাত্রিক সংকট সমাধানে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা আরও শক্তিশালী করতে হবে।
অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য প্রত্যক্ষ করের ওপর জোর দেওয়া জরুরি। বাজেট ও উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে অন্তত মধ্যমেয়াদে স্থিতিশীলতা আনতে পারলে ক্রেতা-ভোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে। এতে অর্থনীতিও গতি পাবে। কার্যকর ও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিলে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষেই সামগ্রিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতার পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
লেখক : অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক ডিন ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা