
দেশপ্রেমিক, সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিটি সেক্টরেই খুব বেশি দরকার। কারণ লোভী ও আত্মকেন্দ্রিক মানুষের মনোযোগ জাতির অগ্রগতি ও উন্নতির দিকে কখনো থাকে না। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে, বোকা বানিয়ে, ধোঁকা-প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে অমানবিক কাজকে বৈধতা দান ও স্বার্থহাসিলের ঘৃণ্য খেলায় তারা মেতে ওঠে। তখনই স্পষ্ট হবে, দেশ পেছনে না চলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, যখন ক্ষমতাসীনরা ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থ ও দশের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেবে।
যেকোনো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পতন অবধারিত বা অবনতি তখনই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন সেই দলে ব্যক্তিপূজা-আত্মপূজা-আত্মরতি ও ব্যক্তিস্বার্থ প্রবল হয়ে ওঠে। মনে রাখতে হবে, যেখানে ক্ষমতার অপব্যবহার আছে এবং জবাবদিহি নেইÑ সেখানে শিক্ষাব্যবস্থার নিপীড়নমূলক কাঠামোর খপ্পরে পড়ে কোমলমতিরা। ক্ষমতার কেন্দ্রে যেতে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা। ভ্রান্তনীতিতে অতিমাত্রায় নিপীড়ক হয় সুবিধাভোগীরা। আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে-ভালোবাসায়-সহানুভূতিতে অপরাধ করে অপরাধীরা। অস্ত্র-পেশীশক্তি দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে ভয়ে ভীত করে সন্ত্রাসী-ডাকাতরূপী জানবাজ সমর্থকরা। যেকোনো সময়ে যেকোনো জাতির ক্রান্তিকালে দেশবাসী সজাগ ও সচেতন হলেই কেবল নিরাশার মাঝেও আশার আলো জ্বালানো যায়। যারা ক্ষমতার সদ্ব্যবহার না করে অপব্যবহার করে তারাও বলে আমরা মানুষের জন্য কাজ করছি। মানুষের পাশে সবসময় আছি, মানুষের জন্যই আমাদের সবকিছু উৎসর্গিত। আসলে যারা অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় লোভে-মোহে, তারা কখনো অন্যের অধিকার আদায়ে লড়াই-সংগ্রাম করতে পারে না। যে নিজেই সব সময় কোনো বাছ-বিচার না করে শুধু খাই খাই করে সে অপরের জন্য নিয়োজিত-নিবেদিত হবেন কী করে! ভালো-মন্দ মানুষ সব জায়গায়ই আছে। তবে মন্দকে মন্দ বলা ও ভালোকে ভালো বলার মতো সংস্কৃতি-পরিবেশ-পরিস্থিতি থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। ঢালাওভাবে শুধু কোনো একজনকে দোষ দেওয়া ঠিক না; সার্বিক ব্যবস্থাটাই স্বাভাবিক ও সুস্থ হতে হবে। অন্যকে অপমান করা, টানাহেঁচড়া করা, অপদস্ত করা, সেবার নামে বাণিজ্য করার অবস্থান মর্যাদা ধরে রাখায় সহায়ক নয়। গালিগালাজ করে, লাঠিসোটা নিয়ে মহড়া দিয়ে, গলাবাজি করে মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায় না। নিজের দেশ ও নিজ দেশের পতাকা-মানচিত্র-স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ভালোবাসার মানে হচ্ছেÑ এদেশের মানুষকে ও মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে ভালোবাসা। এদেশের আকাশ-বাতাসকে ভালোবাসা। এদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সমাজ-সংস্কৃতিকে ভালোবাসা! যার আনন্দ অনেকের বেদনার কারণ হয়, যার অতি চালাকি অনেককে বোকা বানায় ও প্রতারিত করে; তার মুখের মধুর কথা কখনোই অন্তরের কথা হয় না! ভেতরের ভালো মানুষকে বের করে নিয়ে আসার স্বপ্ন পূরণের জন্য অবিরত কাজ করতে হয়। মানুষের ভালোবাসার অসাধারণ বিষয়টুকু অনুভব করতে পারা, পরের ত্যাগ-কষ্টের অমর্যাদা না করার শক্তিটুকু লাভ করা, নতুন ধ্যান-ধারণা দিয়ে নিজের-অন্যের-পৃথিবীর-পরিবেশের সমস্যার সমাধান করে এগোতে পারা এবং সমাজ-সংস্কৃতি-অর্থনীতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে নতুন করে সাজাতে পারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশ-জাতির বৃহত্তর স্বার্থ সুরক্ষায় মনোযোগী প্লাটফর্মই কেবল দেশের মাটি ও মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা ও সাধনা করতে সক্ষম। সংগঠনকে স্থায়ী-টেকসই ও গতিশীল-প্রাণবন্ত রাখতে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম ও নিয়মিত কাজ থাকতে হয়। শুধু ব্যানার বা নামসর্বস্ব প্রাণহীন সংগঠন দু-একটি অনিয়মিত কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। দু-একজন নেতার পকেট সর্বস্ব সংগঠন তাদের অনুপস্থিতিতে মুখ থুবড়ে পড়ে। দু-একজনের দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভরশীল সংগঠন কেউ মুখ ফিরিয়ে নিলেই অসাড়-নিষ্ক্রিয়-মন্থর হয়ে পড়ে। যে সংগঠন সদস্যরা নিবেদিত ও উৎসর্গিত হবে আশা করে, সদস্যদের কল্যাণে-মঙ্গলে পদক্ষেপও তার নিতে হয়। শুধু নিরস কর্মসূচিই না নিয়ে প্রাণচাঞ্চল্য-প্রাণপ্রাচুর্যতায় ভরিয়ে তুলতেও কাজ করতে হয়।
যার পেশাদারিত্ব নেই, পেশাগত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ধার ধারে না। রাজনীতিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে পেশাদার প্লাটফর্মের যেসব নেতৃবৃন্দ যেকোনো উপায়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে সে আসলে পেশাজীবী হয়েও নিজ পেশাকেই ধ্বংস করে। লোভ-স্বার্থের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের সবার মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি হয় না। পেশাজীবী সংগঠনের শীর্ষে থাকাদের চিন্তা-অনুশীলন-অধ্যয়ন-গবেষণা যদি পেশাগত দায়বোধ-দায়বদ্ধতা-দরদ ভেতর থেকে না জাগায় তাহলে পেশাগত উৎকর্ষ ও উন্নতি অসম্ভব।
নির্বাচনসর্বস্ব গণতন্ত্র দিয়ে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা নিশ্চিত হবে না। কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সম্পূর্ণ নতুন রাষ্ট্রচিন্তা ও নতুন ধারার রাজনীতি দরকার। রাজনীতির চরিত্র উন্নতির ধারায় উন্নীত হওয়া প্রয়োজন। ব্যক্তিগত ও দলীয় চিন্তার ধারায় হীনতাবোধে পীড়িতদের ইতিহাস বিকৃতির কার্যক্রম আর যাতে চালু না হয়। জনগণের রাষ্ট্ররূপে গড়তে উন্নত চরিত্রের নেতৃত্ব গড়ে তোলা দরকার। এক্ষেত্রে মোহমুক্ত, অনাচ্ছন্ন, সন্ধিৎসু মন নিয়ে এমন কর্মনীতি নিতে হবে; যাতে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা ও কাজ রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থা দুটিকেই উন্নত করে। তরুণরা শান্তির পক্ষে, সর্বজনীন গণতন্ত্রের পক্ষে, জনগণের ঐক্যের পক্ষে, অবাধ-সুষ্ঠু-নিরেপক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার পক্ষে, ইতিবাচকতা ও সমৃদ্ধির পক্ষে। তারা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য কিংবা বহুত্বমূলক ঐক্যের অপরিহার্যতাকে স্বীকার করে। প্রাপ্য সব সুযোগ দিয়ে অপরাধী ছাড়া বাকি সবার কল্যাণ নিশ্চিতের জন্যই সরকারের কাজ করা উচিত বলে বিশ্বাস করে। যেকোনো সরকারের ভুল কর্মনীতি ও গণতন্ত্রবিরোধী অকল্যাণকর চেষ্টার ব্যাপারে সচেতন ও সতর্ক করে। অমানুষসুলভ কর্মকাণ্ডের কর্তৃত্ব থেকে মানুষকে মুক্ত করে মনুষ্যত্বের বিকাশে তৎপর হতে উদ্বুদ্ধ করে।
রাষ্ট্র কখনো যাতে জনগণকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও বস্তুগত সম্পদ ধ্বংসের কারণ না হয় এবং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব যাতে বিপন্ন না হয়। সেক্ষেত্রে যার যে ভূমিকা পালন করা দরকার তাকে সেই ভূমিকা পালনে যথাযথ পরামর্শ ও সময়োপযোগী দিক-নির্দেশনা দিতে হবে। সুষ্ঠু চিন্তা-ভাবনা অবলম্বন করেই সুষ্ঠু কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সুষ্ঠু রাজনৈতিক ধারায় উত্তরণ সম্ভব হবে। তাদের বেশি দরকার যারা দেশে সুস্থ রাজনীতির চর্চার পক্ষে জনমত গঠনে পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখবে। সমৃদ্ধ দেশ ও উন্নত জাতি গঠন সম্ভব কেবল প্রতিটি সেক্টরেই সঠিক নেতৃত্ব নিশ্চিত করার মাধ্যমেই।
লেখক : সাংবাদিক
[email protected]