ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৩ মার্চ ২০২৫, ২৮ ফাল্গুন ১৪৩১

শাসন ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি

ড. মো. শফিকুল ইসলাম

প্রকাশিত: ১৮:৫৮, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

শাসন ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি

বিকেন্দ্রীকরণ অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাজধানীমুখী হওয়ার কারণে মানুষ ঢাকাতে আসতে চান নানা প্রয়োজনে। যে কারণে রাস্তায় অনেক জ্যাম হয় এবং অনেক মানুষ দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত হয়। যা দেশের জন্য ক্ষতিকর। হরতাল ও অবরোধ ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোর বিকেন্দ্রীকরণ অনেকটা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। অতীতে সড়ক বা ট্রেন দুর্ঘটনায় বিকেন্দ্রীকরণ বিষয়ে মানুষের মাঝে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। অতীতে হরতাল ও অবরোধের প্রভাবে পর্যটন, পরিবহন এবং পোশাক শিল্পে ক্ষতি হয়েছে অনেক। ওই সময়ে শিল্প প্রতিষ্ঠান শ্রমিক ও দেশের স্বার্থে তাদের কারখানা চলমান রেখেছিল। অন্যথায়, দেশের অনেক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। শ্রমিকদের জীবিকার কারণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচিতে অফিসে আসতে হয়েছিল। সরকারি বা নানা কাজের কারণে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় জনগণের আসতে হয়। কিন্তু সেই মুহূর্তে আর্থিক ক্ষতির চেয়ে মানুষের জীবন বড়। দেশের বস্ত্রশিল্প ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বা কাঁচামালের জন্য চীনের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। বাংলাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় চারশ’ সুতার মিল রয়েছে। কিন্তু এসব মিলে সুতার উৎপাদন খরচ বেশি। তাই চীনসহ অন্যান্য দেশ থেকে সুতা আমদানি করতে হয়। বিগত সময়ে হরতাল ও অবরোধের প্রভাবে কাঁচামাল সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে এবং ঝুঁকিতে ছিল গার্মেন্টস শিল্প। পোশাক শিল্পের কারণে ঢাকা বা গাজীপুরে মানুষের সংখ্যা বেশি। কেন্দ্রীয়করণের কারণে রাজধানী ও আশপাশের এলাকাগুলোতে পোশাক শিল্প ঘনীভূত হয়ে গড়ে উঠেছে। চট্টগ্রামেও একই অবস্থা। যদি সব বিভাগীয় শহরে গার্মেন্টস শিল্প গড়ে উঠত, তাহলে এ সময়ে এই অবস্থা নাও হতে পারত। তাই দরকার বিকেন্দ্রীকরণ। বিকেন্দ্রীকরণ থাকলে অতীতে নাদিরা ও নাদিরার নিষ্পাপ ছেলে ইয়াসিনের মতো মানুষ দুর্ঘটনায় নিহত হতো না।    
মানুষকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আনতে হয়। এমনকি অনেক বিভাগীয় শহরে ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। কেন্দ্রীয়করণের কারণে সবকিছু রাজধানীকেন্দ্রিক। যদি বিভাগীয় পর্যায়ে বিকেন্দ্রীকরণ হতো, তাহলে চাকরির বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য ছেলে-মেয়েদের ঢাকায় পাঠানোর দরকার ছিল না। কেন্দ্রীয়করণের জন্য সবাইকে রাজধানীমুখী হতে হয়। নানাবিধ কাজে ঢাকায় যেতে হয়। তাই নানা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ঢাকা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। অন্তত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো বিকেন্দ্রীকরণ হলে এসব সমস্যা অনেকাংশে কমে যেত।
স্বাধীনতার পরে সর্বপ্রথম শেখ মুজিবুর রহমান প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, যাতে স্থানীয়ভাবে ক্ষমতা ও সম্পদ ন্যস্ত করার উদ্যোগ গৃহীত হয়। এ কর্মসূচি বঙ্গবন্ধুর বাধ্যতামূলক গ্রামসমবায় নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, যা তার একটি অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম ছিল। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে স্থানীয় শাসন ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে প্রয়োজনে সংবিধানের ১১, ৫৯ ও ৬০ ধারা পরিবর্তন করে নতুন বিধান সংযোজন করা যেতে পারে। দেশে প্রশাসনিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি জাতীয় বাজেট ও উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিকেন্দ্রীকরণ করাও জরুরি। তবেই আমলাতান্ত্রিক জটিলতার নিরসন ঘটিয়ে দ্রুত উন্নয়নকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব। দেশকে ৪টি প্রদেশে ভাগ করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, যে  কমিশন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত। দেশের পুরনো চারটি বিভাগের সীমানাকে চারটি প্রদেশে বিভক্ত করে প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা চালু করার কথা বলা হয়েছে সুপারিশে। এটা নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ হতে পারে।
কেন্দ্রীয়করণে নেতিবাচক কিছু বিষয় রয়েছে। প্রথমত, কেন্দ্রীভূত পরিচালনায় আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্ব ও রূপের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ কার্যক্রম বেশি দেখা যায়। যেখানে অধস্তন কর্মচারীরা কেবল শীর্ষ নির্বাহীগণের নির্দেশে কাজ করবে এরকম আশা করা হয়। এই ব্যবস্থাপনায় নিম্নশ্রেণির কর্মচারীরা প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ কম পায় এবং তারা কেবল উচ্চমহলের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী হিসেবে কাজ করে। দ্বিতীয়ত, এমনকি যখন নিম্নস্তরের কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অসুবিধার সম্মুখীন হয়, সেই ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ সহজেই সমস্যা সমাধান করতে বা বুঝতে পারে না। কারণ তারা কেবল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এবং সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নকারী নয়। এতে কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। নিম্নস্তরের কর্মচারীদের মতামত ব্যতীত শীর্ষস্তরের নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রেরণার অভাব লক্ষ্য করা যায়। সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের তদারকি করার জন্য নির্বাহীদের হাতে তেমন সময় থাকে না। কারণ তাঁরা বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকে। এতে কর্মীদের কাজের প্রতি অনীহা ও অবহেলা বৃদ্ধি পায়।  
এছাড়াও কেন্দ্রীয়করণের আরও সমস্যা রয়েছে। যেমনÑ এ প্রক্রিয়ায় কাজ সম্পন্ন করতে বিলম্ব হয়। কারণ সবকিছু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে হয়। কোনো কিছু বাস্তবায়নের জন্য সকল প্রকারের কাগজপত্র ঢাকায় পাঠাতে হয়, যা প্রকল্পের কাজ বিলম্বিত করে। কর্মচারীরা উপর মহল থেকে প্রদানকৃত তথ্যের ওপর নির্ভর করে কাজ করে। এতে তাদের সৃজনশীলতা হ্রাস পায়। এছাড়াও কেন্দ্রীয়করণে নিম্নশ্রেণির কর্মচারীর ব্যক্তিগত স্বাধীনতা কম থাকে। কারণ তারা শীর্ষ নির্বাহীদের মতামত অনুযায়ী কার্য সম্পাদন করে।
অন্যদিকে, বিকেন্দ্রীকরণের অনেক ইতিবাচক দিক আছে, যা অনেক সমস্যারই সহজ সমাধান এনে দিতে পারে। যেমনÑ ১) বিকেন্দ্রীকরণে মাঠপর্যায়ে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব। এতে কাজের বাস্তবতা ও ক্ষেত্রের সঙ্গে সমন্বয় রাখা হয়। এতে কর্মস্থলে কাজের গতি বৃদ্ধি পায় এবং তাদের বেশি কাজ করার অনুপ্রেরণা পাওয়ার সম্ভবনা থাকে। ফলে তারা তাদের নিয়ন্ত্রণে প্রতিটি দায়িত্ব  সম্পর্কে সম্পূর্ণ সতর্ক ও তৎপর থাকে। কোনো সমস্যা বা ভুল ধরা পড়লেও সঙ্গে সঙ্গে তারা  সংশোধনমূলক পদক্ষেপ নিতে পারে। ২) বিকেন্দ্রীকরণে অধীনস্থ কর্মচারীরা ব্যাপক উৎসাহ পেয়ে থাকে, যা তাদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করে। এ প্রক্রিয়ায় নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণের সুযোগ পায় বলে তাদের মেধা ও সৃজনশীলতা প্রয়োগের ক্ষেত্র তৈরি হয়। ৩) বিকেন্দ্রীকরণ শীর্ষ নির্বাহীদের কাজের চাপ হ্রাস করে এবং বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করার ঝামেলা থেকে শীর্ষ কর্মকর্তাদের মুক্তি দিয়ে থাকে। ফলে শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা এই সময়ে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কার্যপরিচালনায় মনোনিবেশ করতে পারে। যা একমাত্র বিকেন্দ্রীকরণে সম্ভব। ৪) বিকেন্দ্রীকরণে সকল এলাকার প্রত্যেক মানুষের জীবনমান উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সমাজে বৈষম্য কমিয়ে আনা সম্ভব হয়। এটা সম্ভব হলে সমতা ও সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা যায়।
সবকিছু ঢাকা কেন্দ্রিক হওয়ার ফলেই আজ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এমন পরিণতি। প্রত্যেক জেলা ও বিভাগের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজানো প্রয়োজন, যাতে সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়। যাতে উন্নত চিকিৎসার জন্য অ্যার অ্যাম্বুলেন্স করে ঢাকায় না যেতে হয়। ঢাকায় আসতে আসতে পথে অনেক রোগী মরে যাওয়ার ইতিহাস রয়েছে। কেন্দ্রীয়করণের জন্য করোনা বা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৭৫ শতাংশ রোগী ঢাকায় ছিল। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের দিকনির্দেশনায় আমরা অনেক ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণের দিকে যাচ্ছি। প্রত্যেকটি জেলায় মেডিক্যাল কলেজ স্থাপিত হচ্ছে। এটা প্রশংসার দাবি রাখে। তবে মেডিক্যাল কলেজ করলে হবে না, সকলের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। আরও ভালো হয় যদি ঐসব কলেজে সব চিকিৎসা সরঞ্জাম দেওয়া হতো।
বিকেন্দ্রীকরণ হলে ঢাকার ট্রাফিক জ্যাম কমে যেত। ঢাকাবাসী প্রকৃতির সঠিক রূপ উপভোগ করতে পারত। কমে যেত বায়ুদূষণ। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখাও সম্ভব হতো। তাই কেন্দ্রীয়করণের সব নেতিবাচক দিক বর্জন করে ইতিবাচক বিষয়গুলোকে বিবেচনা করে প্রশাসনিক ও সকল পর্যায়ে বিকেন্দ্রীকরণের প্রক্রিয়া চালু করা এখন সময়ের দাবি।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

×