ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৭ ফাল্গুন ১৪৩১

দেশে নদীশাসন ব্যবস্থা প্রত্যাশিত

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশিত: ২০:৪০, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

দেশে নদীশাসন ব্যবস্থা প্রত্যাশিত

সকলের জানা যে, নদী ভাঙন রোধ করার উদ্দেশ্যে নদীপৃষ্ঠ থেকে পাড়ের উচ্চতায় বড় বড় পাথর ফেলে বা কংক্রিটের তৈরি বিশাল আকারের নানা রকমের ব্লক দিয়ে জলের স্রোতের গতিপথ পরিবর্তনই নদীশাসনের প্রণিধানযোগ্য বৈশিষ্ট্য। ভূমিক্ষয় রোধ এবং পাড়ের মাঝে বাঁধ দিয়ে পাড় ভাঙন বন্ধ করার প্রক্রিয়া উল্লেখ্য ব্যবস্থার অন্যতম কার্যক্রম। নদীর নাব্য ও গভীরতা বজায় রাখার নিমিত্তে নদীর তলদেশ থেকে বালি উত্তোলন, পানি প্রবাহ ও নদীর পরিবেশ ধরে রাখা নদীশাসনের মুখ্য অনুষঙ্গ। যে কোনো জাতিরাষ্ট্রে নদীশাসন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বড় ধরনের জলাধার নির্মাণ, হাওড় অঞ্চলের সংস্কারপূর্বক পানি ধারণ এবং পানির গুণগতমান বাড়ানোর মতো নানা উদ্যোগ গ্রহণ আবশ্যক। দেশে মরুকরণ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পানি সংরক্ষণ, উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানির চাপ প্রতিরোধ এবং অনাকাক্সিক্ষত বন্যা রোধ করা সম্ভব হয়। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হওয়ার সুবাদে দেশের মানুষের জীবন-জীবিকাসহ জনজীবনে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। ইতিহাস পর্যালোচনায় এটি সুস্পষ্ট যে, সুপেয় পানি-চাষাবাদ-যাতায়াতের সুবিধার্থে পৃথিবীর প্রাচীন সব সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল নদীকে কেন্দ্র করেই। এদের মধ্যে ইরাকের ইউফ্রেটিস-তাইগ্রিস নদের সুমেরীয় সভ্যতা, সিন্ধু নদের মোহেনজোদারো-হরপ্পা সভ্যতা, চীনের হোয়াংহো-ইয়াংসি নদী সভ্যতা এবং মিসরীয়দের নীল নদের সভ্যতা উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশেও সভ্যতা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যসহ মানুষের জীবন-অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নদ-নদীর নিগূঢ় সম্পর্ক অনস্বীকার্য। দেশের ও জনগণের বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক কল্যাণে নদীশাসনের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।  
গণমাধ্যমে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুসারে, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীর ৫৪টি এসেছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মেঘালয় ও অসম থেকে এবং তিনটি এসেছে মিয়ানমার থেকে। সমসূত্র মতে, বহুকালব্যাপী ভারতের একতরফা অভিন্ন নদীশাসনের ফলে ভাটি অঞ্চলে বাংলাদেশের নদ-নদীর পানি প্রবাহ কমে বিস্তীর্ণ এলাকায় জেগে উঠেছে চর। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত। কালের পরিক্রমায় হ্রাস পেয়েছে দেশের নদ-নদীর সংখ্যা। সরকারি ত্যথমতে, দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০০টি। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের নদ-নদী শীর্ষক গ্রন্থ অনুসারে, দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ৩১০টি। পরবর্তীতে ২০১১ সালে নদ-নদীর সংখ্যা হয় ৪০৫টি। সর্বশেষ, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪ গণমাধ্যমে উপস্থাপিত পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের খসড়া তালিকা অনুযায়ী দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ১১৫৬টি। গবেষকদের মতে, প্রতিবছর গড়ে ১০টি নদীর অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ইতোমধ্যে দখল ও দূষণের কারণে বিলীন হয়ে গেছে ২৫টি নদী। বর্তমানে বিপন্ন নদীর সংখ্যা ১৭৪টি। ১৯৭৫ সালে বিআইডব্লিউটিএর জরিপ অনুযায়ী, দেশে ২৪ হাজার নৌপথের তথ্য পাওয়া যায়। বর্তমানে সচল নৌপথের মধ্যে ১২-১৩ ফুট গভীরতা সম্পন্ন প্রথম শ্রেণির নৌপথ রয়েছে ৬৮৩ কিলোমিটার, ৭-৮ ফুট গভীরতার দ্বিতীয় শ্রেণির নৌপথ রয়েছে প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার এবং ৫-৬ ফুট গভীরতায় তৃতীয় শ্রেণির নৌপথ রয়েছে ১ হাজার ৮৮৫ কিলোমিটার।
এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, দেশের প্রায় সকল এলাকার নদী-খাল-বিল অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়ার কারণে প্রতিনিয়ত পানিপ্রবাহের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। ফলে নদ-নদীর সংকীর্ণতায় বর্ষাকালে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হয়ে গ্রামীণ এলাকায় বৃষ্টির পানি জমে ফসল ও বাড়িঘর তলিয়ে যাচ্ছে। একইভাবে শহরাঞ্চলের ড্রেনেজ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়ে বৃষ্টি-অতিবৃষ্টিতে পানি জমে সৃষ্টি করছে জলাবদ্ধতা। এতে পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখোমুখি হচ্ছে। নদী গবেষকদের মতে, নদী কখনো একা মরে না। নদীর মৃত্যু হলে পাড়ের জনপদও একটু একটু করে মরতে শুরু করে। রাজধানী ঢাকা যদি বুড়িগঙ্গার মৃত্যুর কারণ হয়, তবে নদীর মৃত্যুতে ঢাকার অবস্থাও এখন মুমূর্ষুপ্রায়! বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বংশী, বালু এবং শীতলক্ষ্যা নদীর দুধারে গড়ে ওঠা শিল্প কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্যরে বিষক্রিয়ায় এসব নদী ধীরে ধীরে প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন দ্রুত নদীশাসনের ব্যবস্থা করা।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, ভুল নদীশাসন, দখল ও দূষণের কারণে এখন অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে দেশের সিংহভাগ নদী কিংবা খাল। ঢাকাসহ বাংলাদেশের নদীগুলোর দখল ও দূষণমুক্ত করতে আদালত থেকেও বারবার নির্দেশনা এসেছে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রায়ই নদীর ওপর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত রাখলেও পরক্ষণেই আবার দখল হওয়ার দৃষ্টান্তও রয়েছে। নদীর অবৈধ দখল, পানি-পরিবেশ দূষণ, শিল্প-কারখানা কর্তৃক নদী দূষণ, অবৈধ কাঠামো নির্মাণসহ নানাবিধ অনিয়ম রোধকল্পে এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ পুনরুদ্ধার, নদীর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ, নৌপরিবহনযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন করেও কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। ২০২০ সালে এটি সংশোধনের উদ্দেশ্যে খসড়া জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০২০ প্রণয়ন করা হয়েছে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০২০ এর উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছেÑ বাংলাদেশের সকল নদ-নদী-জলাধার-খাল-বিল-সমুদ্র উপকূল-হাওড়-বাঁওড়-জলাভূমি-জলাশয়-ঝর্ণা-হ্রদসহ পানির উৎস সব কিছুই এর আওতার মধ্যে থাকবে। বাংলাদেশের সকল প্রকার নদ-নদী, জলাধার, পানির উৎস রক্ষা করা; অবৈধ দখল মুক্তকরণ; নদীর তীরে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ, বিলুপ্ত বা মৃতপ্রায় নদী খননের বিষয়ে পরিকল্পনা তৈরি করা। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবহমান সকল নদী আইনি ব্যক্তি ও জীবন্ত সত্তা হিসেবে বিবেচিত হবে। সকল নদীও একই মর্যাদা প্রাপ্ত হবে। সেই সঙ্গে সকল নদী পাবলিক ট্রাস্ট ডকট্রিনের আওতায় হওয়ায় সেগুলো বিবেচিত হবে জনসম্পত্তি বলে। সরকারি কোনো কর্মকর্তাও যদি নদ-নদীর জায়গা, তীরভূমি প্রভৃতি অবৈধভাবে কারও নামে বরাদ্দ করেন, তারাও অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবেন। প্রতিটি বিভাগে ‘নদী রক্ষা কোর্ট’ নামে এক বা একাধিক কোর্ট থাকবে। নদী ও জলাধার সংক্রান্ত সকল বিষয় নিয়ে এ আদালত বিচার করবেন। এ ছাড়াও প্রয়োজন অনুযায়ী মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবে। নদী দখল, দূষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে শাস্তি দিতে পারবে মোবাইল কোর্ট। কমিশন ছাড়াও নদী রক্ষার্থে যে কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা নাগরিক কোর্টে অবৈধ দখল উচ্ছেদ, পুনরুদ্ধার ও দূষণ রোধের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করতে পারবেন। অত্যন্ত প্রায়োগিক বিবেচনায় আইন প্রণীত হলেও কার্যত এর বাস্তবায়ন কতটুকু দৃশ্যমান, তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
যথাযথ নদীশাসনের অভাবে প্রতিবছরই প্রধান প্রধান নদীর তীর ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি, আবাদি জমি, হাট-বাজারসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা। নদীর অব্যাহত ভাঙনে প্রতিদিনই নিঃস্ব হচ্ছে নদী পাড়ের মানুষ। ফলস্বরূপ দেশের মোট জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রায় এর প্রভাব অধিকতর বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিবছর বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন বিপুলসংখ্যক মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। আশা জাগানিয়া বিষয় হচ্ছে, দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে নদ-নদীর গুরুত্ব বিবেনায় ভরাট হওয়া নদ-নদী পুনরুদ্ধার ও নাব্য রক্ষাকল্পে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নদীগুলোতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংসহ নানা কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ অন্তর্বর্তী সরকারের ৬ মাসের কার্যক্রম নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নদী দূষণ ও উদ্ধার প্রসঙ্গে জানান, বিশ্বের কোনো দেশকে নদী দূষণে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়নি। নদী এবং খালগুলো রক্ষায় পলিউশন পয়েন্ট (দূষণ স্থান) নির্ণয়ে জিপিএস প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘দেশের ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে ৬৪টি নদী দখল ও দূষণমুক্ত করতে বাজেটসহ কর্মপরিকল্পনা নিয়েছি। এগুলোর মধ্য হতে সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করবে। ইতোমধ্যে নদী দখল ও দূষণমুক্ত করতে কাজ শুরু হয়েছে।’ নদী ভাঙন-দূষণ-দখল প্রতিরোধে টেকসই নদীশাসন ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক। দীর্ঘকালব্যাপী বাচনিক প্রতিশ্রুতিতে নদীশাসনের অব্যবস্থাপনায় জনদুর্ভোগ লাঘবে বাস্তবসম্মত কর্মকৌশল তেমন পরিলক্ষিত না হলেও, এ সংক্রান্ত বিষয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মনোযোগ অতীব জরুরি। জরুরি স্বল্প-দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কার্যকর পন্থা অবলম্বন ব্যাহত হলে এর নেতিবাচক পরিণতি পুরো দেশকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সুপরিকল্পিত প্রয়োজনীয় যৌক্তিক সংস্কারের অংশ হিসেবে নদীশাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ শুধু তাৎপর্যপূর্ণ নয়; জনদুর্ভোগ লাঘবে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব  জাতির উন্নয়নে নিয়ামক হিসেবে বিবেচ্য হবে।  

লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী

×